
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২১, ১২:০৪ এএম
সিরাজুল ইসলাম শিশির, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
করোনাভাইরাসের প্রভাবে দর্শক সংকট ও ডিজিটাল না হওয়ায় একের পর এক বন্ধ
হয়ে গেছে সিরাজগঞ্জের সিনেমা হলগুলো। ভারতীয় সংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ডিশ লাইনে বিদেশি
সিনেমার কারণেই এমনটি হয়েছে বলে দাবি করেছেন হল মালিকেরা। অপরদিকে সাধারণ দর্শকেরা
মনে করছেন সুষ্ঠু চিন্তার চলচ্চিত্র বাংলাদেশ থেকে দিন দিন হারিয়ে যাওয়ায় ও পশ্চিমা
সংস্কৃতি, পার্শ্ববর্তী ভারতের আধুনিক সিনেমার নিকট
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রভাব পড়েছে।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের ৩৩ লাখ মানুষের বিনোদনের প্রধান ক্ষেত্র ছিল সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার ৫টি এবং বিভিন্ন উপজেলার ২০টিসহ প্রায় ২৫টি সিনেমা হল। কিন্তু নানা সংকটের মধ্যে পড়ে এগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। দর্শক সংকট, নিম্নমানের চলচ্চিত্র, সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানামুখী কারণে সিনেমা হলগুলো আর চলছে না। কোনো কোনো হলের মালিক সিনেমা হলগুলোকে খাদ্যগুদাম, কমিউনিটি সেন্টার, প্যাথলজি, মার্কেট এমনকি ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন।
এক সময় শহরের ইবি রোড়ের লক্ষ্মী, মমতাজ, নীলা, বাহিরগোলা রোডের গোধূলী এবং স্টেশন রোডের মৌসুমী সিনেমা হলগুলোতে এক সময় দর্শক সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে হতো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের ভিড়ে মুখরিত থাকত সিনেমা হলগুলো। বর্তমানে সেগুলো এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
নীলা সিনেমা প্রায় ১৭ বছর ধরে বন্ধ, লক্ষ্মী প্রায় ১৪ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সেখানে বর্তমানে ইঁদুর আর মাকরসার বসবাস, গোধূলী থেমে থেমে চললেও দুই বছর আগে বন্ধ ঘোষণা করে মালিকপক্ষ। পরে অবকাঠামো ভেঙে সেখানে ডায়গনস্টিক সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ শহরের মমতাজ সিনেমা হল ও মৌসুমী সিনেমা হল কোনো মতে চললেও গত বছর করোনা মহামারির কারণে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ ঘোষণার পরে মমতাজ সিনেমা হল এখন ছাত্রাবাস ও গোডাউন ভাড়া দেয়ার জন্য সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছে। অপরদিকে মৌসুমী সিনেমা হল বন্ধ করায় বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।
অপরদিকে জেলা শহরের বাহিরে তাঁত শিল্প ও শ্রমজিবী এলাকা খ্যাত বেলকুচি, শাহজাদপুর উল্লাপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় সবগুলো সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে।
তাঁত শিল্প এলাকা খ্যাত বেলকুচি উপজেলার বাসিন্দা পারভেজ আলী জানান, কেবল বেলকুচিতেই এক সময় ১৭টি সিনেমা হল চালু ছিল কালের বিবর্তনে সবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
সিরাজগঞ্জ লক্ষ্মী সিনেমা হলের শংকর শিং নামে এক কর্মচারী জানান, ১৯৪৪ সালে লক্ষ্মী সিনেমা হলে চাকরি নেন, চাকরি শেষ হয় ২০০৪ সালে। লক্ষ্মী সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখন অলস সময় কাটে লক্ষ্মী সিনেমা হলেরই সামনে দুলাল দার মিলন মাইক সার্ভিসে বসে বসে।
সিরাজগঞ্জ শহরের মমতাজ ও মৌসুমী সিনেমা হলের কয়েকজন কর্মচারী জানান, আগে প্রতিটি হলে ২৫ থেকে ৩০ জন লোক কাজ করত। লোকসানে পড়ায় মালিকেরা সিনেমা হল বন্ধ করে দেয়াতে অনেক কর্মচারী বেকার হয়ে মানবতার জীবন যাপন করছে।
সিরাজগঞ্জের দীর্ঘ দিনের সিনেমা হল ব্যবসায়ী ও মমতাজ সিনেমা হলের মালিক সেখ ইমতাজ আলী কুমকুম বলেন, ‘দেশের চলচ্চিত্র জগতে যেমন ধস নেমেছে তেমনি সিনেমা হলগুলোর একই অবস্থা। পর্যাপ্ত দর্শকের অভাবে আমরা এ ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। একই সঙ্গে সরকারি সুযোগ-সুবিধা না থাকা এবং অধিক হারে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিই এখন ব্যবসার প্রতিবন্ধকতার প্রধান কারণ।
তিনি আরও বলেন, ‘সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিনেমাতেও উন্নত প্রযুক্তি ঢুকেছে। কিন্তু এ জেলার সিনেমা হলগুলো সে তুলনায় আধুনিক নয়। ভালো ছবির সঙ্গে সঙ্গে উন্নতমানের সিনেমা হলই পারে দর্শকদের সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু এতে যে পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন, সে টাকা হল মালিকদের নেই। এখানে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।’
সিরাজগঞ্জ স্বার্থ রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা বলেন, সিরাজগঞ্জ শহরে একসময় পাঁচটি সিনেমা হল ছিল। সেই নির্বাক যুগের আমল থেকেই প্রধান বিনোদনকেন্দ্র ছিল এই সিনেমা হলগুলি। শুধু শহরের মানুষ নয়, সারা জেলার, সকল স্তরের, সকল ধর্মের মানুষই এই হলে ছবি দেখতে আসত। কিন্তু বর্তমানে সবগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়াতে মানুষ বিনোদনহীন হয়ে পড়েছ। এখন আর সিনেমা হলগুলো বাইরে থেকে চেনা যায় না।
সিরাজগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারার অফিসার মো. মাহমুদুল হাসান জানান, সিনেমা হলগুলো মূলত তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে এখানে আমাদের সহযোগিতা ও উন্নয়ন করার বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে আমরা ছোট ছোট ফিল্ম তৈরি করে প্রজেক্টর মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশন করে থাকি।
জেডআই/এম. জামান