প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২১, ০১:৩০ এএম
রুবেল মিয়া। বয়স ৩০ বছর। তার বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, সড়ক দুর্ঘটনায় তার মা-বাবার মৃত্যু হয়। সে দুর্ঘটনার সময় রুবেল বেঁচে যান। বেঁচে যাওয়া সত্ত্বেও এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পর তার
আশ্রয় হয় বাবার চাচাতো বোনের বাসায়। অসচ্ছল ও দারিদ্র্যের মধ্যে চাচাতো ফুফুর
আশ্রয়ে বেড়ে ওঠেন তিনি। সেখানকারই এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস
করেন। এরপর অনার্সে ভর্তি হন গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে। সে সময় তার ফুফুর
মৃত্যু হয়। এতে থমকে যায় সব কিছু। পরে ড্রাইভিং শিখে চালকের চাকরি নেন রুবেল।
২০১৯ সালে আঁখি আক্তার নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে
রুবেল-আঁখি দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান। তার নাম রাখা
হয় রুবাইয়া।
তাদের এই সংসারে সুখ আসবে ভাবতেই ভাগ্যের কঠিন পরিহাসে সন্তান জন্মের তিন দিন
পরই মৃত্যু হয় স্ত্রী আঁখি আক্তারের। গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে
মেয়েকে বড় করতে থাকেন। মেয়ের দেখাশোনার জন্য মাসিক বেতনে একজন গৃহপরিচারিকা রাখেন।
সংসার যেন শুধু বাবা ও মেয়ের। বাবার হাতে গোসল, বাবার হাতে খাওয়া, বাবার কোলেই ঘুম যেন শিশুটির সবই ছিল বাবাকে ঘিরেই।
অতি স্নেহ ও ভালোবাসায় নিজের কন্যাকে মায়ের শূন্যতা পূরণ করার এক আপ্রাণ চেষ্টা
চলছিল তার।
গত মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) দুপুরে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় ঘুমাচ্ছিলেন
রুবেল। আর মেয়েটি খেলছিল ঘরের ভেতর। হঠাৎ করেই বাবার চোখের আড়াল হয়ে যায় মেয়ে
রুবাইয়া। একটি জামা হাতে ঢুকে পড়ে গোসলখানায়। সেখানে জামাটি ভেজাতে গিয়ে উল্টে পড়ে গামলার পানিতে ডুবে করুণ মৃত্যু হয় রুবাইয়ার।
রুবেলের একমাত্র সম্বল ছিল তার
কন্যা। সে এখন বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে শোকে স্তব্ধ।
বুকে পাথর চাপা কষ্ট নিয়ে মনের সঙ্গে যেন
প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে।
রুবেল মিয়া ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ গ্রামের মৃত আব্দুল হেকিম ও
হালিমা বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান। বর্তমানে থাকেন গাজীপুরের শ্রীপুরের মুলাইদ
গ্রামে। একের পর এক স্বজন হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি। মনের অব্যক্ত কথাগুলোও
যেন প্রকাশ করতে তাকে ভেঙে পড়তে হয় বারবার।
রুবেল মিয়া বলেন, ‘ছোটকালে বাবা-মায়ের ভালোবাসা কী রকম তা টের পাইনি। যখন বড় হলাম তখন জীবনের
সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। অনেক স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে ভালো কোনো চাকরি করব। অভাব
ঘুচিয়ে সংসার পাতব। অভাবের কারণে স্নাতক শেষ করতে পারিনি। পরে একটি সময় এসে বিয়ে
করে সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম। তাও মেলাতে পারিনি নিজের ভাগ্যের সঙ্গে।’
দুনিয়াতে আসার পর মা-বাবা, পরে স্ত্রী, সর্বশেষ সন্তান চলে যাওয়ায় এখন যেন হৃদয় শূন্য হয়ে গেছে।
বারবার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলো। এখন আমার কোনো কাছের
স্বজন বলতে কেউ নেই। কাকে নিয়ে বাঁচব?
তিনি বলেন, ‘গত ২৩
মাস ধরে মা হারা মেয়েকে বড় করতে কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি তার হিসাব নেই। শত কষ্ট
মিলিয়ে যেত মেয়ের একটু হাসিতেই। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর অনেকেই বিয়ের পরামর্শ
দিয়েছিল। তবে সৎ মা মেয়েকে কীভাবে নেবে এটা ভেবেই বিয়ে করিনি। মেয়ের বাবা ও মা
একাই হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস সব শেষ হয়ে গেল।’
শ্রীপুরের মাওনা গ্রামের মো. নাইম মিয়া বলেন, ‘রুবেল দীর্ঘদিন ধরেই আমার গাড়ি চালান। তিনি খুবই বিনয়ী ও ভদ্র। একজন সন্তানের জন্য বাবার কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকে তা প্রায় দুই বছর ধরে দেখেছি। মেয়েটিকে হারিয়ে রুবেল এখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আসলে বাবা ও মেয়ের ভালোবাসা সবকিছুর চেয়ে ব্যতিক্রমও।’
অর্ণব/এম. জামান