প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২১, ১২:০৩ এএম
স্বল্পসংখ্যক ফেরি চলাচল করায় মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌরুটে যাত্রীদের
দুর্ভোগ বেড়েছে চরমে। এই নৌরুটে ফেরি চলাচলের নামে চলছে শুধু প্রহসন। মাত্র ৪টি ফেরি
দিয়ে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মাত্র ১০ ঘণ্টা ফেরি সার্ভিস চালু রাখায় প্রতিদিন
দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত শত শত গাড়ি পদ্মা পার হতে না পেরে ফিরে যাচ্ছে।
দূরবর্তী জেলা থেকে আসা ছোট-বড় যানবাহনগুলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে অপেক্ষা করে বিকেলে
যখন ফেরিতে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন বিকল্প নৌরুটে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। রাতে ঘাটের
টার্মিনালে থাকতে হচ্ছে যানবাহনগুলোকে।
বিআইডব্লিউটিসির বাংলাবাজার ঘাট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর বর্ষা মৌসুমে স্রোতের তীব্রতার কারণে পদ্মা সেতুর
পিলারে একাধিকবার ফেরির ধাক্কা লাগে। এরপর থেকেই ফেরি চলাচল ব্যাহত হতে থাকে। তাই দুর্ঘটনা
এড়াতে গত ১৮ আগস্ট ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। এরপর টানা ৪৭ দিন বন্ধ থাকার
পর গত ৫ অক্টোবর সীমিত আকারে ফেরি চালু হয়। পরে মাত্র ৬ দিন চলার পর স্রোতের তীব্রতা
বৃদ্ধির কারণে আবারও ফেরি বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। এ সময় টানা ২৮ দিন বন্ধ থাকার পর গত
৮ নভেম্বর থেকে পুনরায় ফেরি চালু হয় বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে। তবে সকাল ৬টা থেকে
বিকেল ৪টা পর্যন্ত (রোকেয়া, কুঞ্জলতা, কদম ও সুফিয়া কামাল) নামে ৪টি ফেরি চালু রাখার
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে সময় ভারী যানবাহন পারাপার বন্ধ রেখে শুধু হালকা যানবাহন পার
করা হয়।
তবে
যারা নিয়মিত এ ঘাটটি ব্যবহার করেন তারা দুর্ভোগের শিকার হতে থাকেন। দক্ষিণাঞ্চলের
২১ জেলা থেকে অসংখ্য ছোট যানবাহন ঘাটে এলেও ফেরিস্বল্পতার কারণে ফেরি পারাপার হতে
না পেরে ফিরে যাচ্ছে ঘাট থেকে। এসব যানবাহনের সঙ্গে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সকেও ফিরে
যেতে দেখা যায়। জরুরি অবস্থায় দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ছুটতে হচ্ছে
তাদের।
শুক্রবার
(৩ ডিসেম্বর) বেলা ১১টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ঘাটে সরেজমিনে দেখা যায়, খুলনা, বরিশাল, বাগেরহাট,
গোপালগঞ্জ, পিরোজপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস,
পিকআপ এবং অ্যাম্বুলেন্স চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘অনেকেই সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত ঘাটে ফেরিতে ওঠার
সুযোগ পাননি।’ অনেকে আবার বলছেন, 'কিছুক্ষণ পরে ফেরি চলাচল বন্ধ হবে। মনে হয় না আজ পার
হতে পারব!’
বাংলাবাজার
ঘাটে এসে পার হতে না পেরে বিকল্প রুটে ফিরে যেতে জ্বালানি খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। অনেকে
পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও পার হতে না পেরে চরম ভোগান্তি
আর কষ্ট নিয়ে ফিরে যান।’
এই
নৌরুটে ফেরিস্বল্পতার কারণে ঘাটে দুর্ভোগ বেড়েছে। মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) শতাধিক গাড়ি
ফেরি পার হতে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুট দিয়ে পার হতে বাংলাবাজার ঘাট
ত্যাগ করেছে। আবার অসংখ্য গাড়ি ঘাটের টার্মিনালে রয়েছে পরের দিন সকালে পার হওয়ার জন্য।
এদিকে
বাংলাবাজার ঘাট এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টাকা
নিয়ে কিছু যানবাহনকে ফেরিতে ওঠার সুযোগ করে দেয় বলেও অভিযোগ করছেন কয়েকটি যানবাহনের
চালকেরা। সে ক্ষেত্রে সিরিয়াল ভেঙে পেছনের গাড়িও ফেরিতে উঠানো হয় বলে অভিযোগ তাদের।
অন্যদিকে,
ভিআইপিদের যাঁতাকলে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে
আটকে থাকতে হচ্ছে সাধারণ ট্রাক, পিকআপ ও মাইক্রোবাস চালকদের। দেখা যায় অনেক ভিআইপি তাদের লোকজনকে পার করার জন্য ঘাট এলাকায়
কর্তব্যরত পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের মেসেজ দিয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনকে পার করে নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অনেকে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থেকেও ফেরিতে উঠতে পারছেন না।
বাংলাবাজার
ঘাটে সিরিয়ালে থাকা একাধিক চালকেরা জানান, অনেক ভিআইপি ঘাটের কর্মকর্তাদের মেসেজ দিয়ে
বা কোনো উপায়ে ব্যবস্থা করে তাদের লোকজনকে পার করে নিচ্ছে। আজ সারা দিনে সিরিয়ালে থাকা
অনেকে বিকেল পর্যন্ত থেকে গাড়িতে উঠতে না পেরে আবার ফেরত চলে যাচ্ছে।
তবে
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন বাংলাবাজার
ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) মো. জামাল উদ্দিন।
জাহাঙ্গীর
নামে শরীয়তপুর থেকে আগত এক পিকআপ চালক বলেন, ‘সকাল ৯টায় ঘাটে আসছি, এখন ৩টা বাজে।
ভিআইপিদের গাড়িগুলো ছেড়ে যাচ্ছে আমরা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি ৬ ঘণ্টা ধরে। অনেকে ভিআইপি
পরিচয়ে পিকআপ পার করে নিচ্ছে।’
রোমান
নামে গোপালগঞ্জ থেকে আসা এক প্রাইভেট কার চালক জনান, গাড়িতে আমার ছোট তিনটি বাচ্চাসহ
আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসছি। একটি বাচ্চা অসুস্থ। এখানে যেভাবে লাইনে দাড় করিয়ে রাখছে
তাতে বাচ্চাটি আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের লাইন থেকে ২২টি গাড়ি গেছে বাকি সব নাকি
ভিআইপি। এ দিকে অনেকে ব্যবস্থা করে ফেরিতে উঠে যাচ্ছে। কিভাবে উঠছে তা কেউ বলেও না।
তবে গাড়ির সংখ্যা প্রচুর এই ঘাটে। সে তুলনায় ফেরি নাই। একটি ফেরি ছেড়ে গেলে আরেকটি
আসতে অনেক সময় লাগে।
নাম
প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাইভেট কার চালক বলেন, ‘ঘাটে দুরবস্থা। ভোগান্তির শেষ নেই। দীর্ঘসময়
অপেক্ষায় থেকেও ফেরিতে উঠতে পারলাম না। আবার পুলিশকে ম্যানেজ করে কেউ কেউ উঠেও যাচ্ছে।
যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করতে সময় এবং ফেরির সংখ্যা দ্রুত বাড়ানো উচিত।’
বিআইডব্লিউটিসির
বাংলাবাজার ঘাটের সহ-ব্যবস্থাপক সামসুল আবেদিন বলেন, ‘এই নৌরুটে ফেরি সংখ্যা এবং সময়
না বাড়ানো জরুরি। তা নাহলে যাত্রী ও যানবাহনের দুর্ভোগ শেষ হবে না। এত কম সময়ে যাত্রীদের
সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। কারণ মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা প্রতিদিন
যে পরিমাণে ঘাটে আসে তাতে শতাধিক যানবাহন ফেরিতে উঠতে ব্যর্থ হয়। ভোর থেকে বিকেল সাড়ে
৪টা পর্যন্ত শত শত গাড়ির ভিড় থাকে ঘাটে। ফেরিতে ওঠার রাস্তা গাড়িতে ব্লক হয়ে যায়।
জরুরি অ্যাম্বুলেন্সও তখন ফেরিতে উঠানোর সুযোগ থাকে না। ফেরির সংখ্যা এবং রাতে চলাচল
শুরু না হলে এই দুর্ভোগ আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। ফেরি চলাচলে সময় এবং সংখ্যা বাড়ানোর
কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। হবে কি না তাও জানা নেই। তবে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে জানানো
হয়েছে বিষয়টি।’
এআরআই/এম. জামান