প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২১, ০৭:৪৫ পিএম
জুয়েল রানা, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
সুফিয়া বেগম। বয়স আনুমানিক পঞ্চান্ন। বসবাস টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার জোত আতাউল্লাহ ব্যাপারী বাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই ঘানি ঘোরানোর আওয়াজের সঙ্গে তার বেড়ে ওঠা। আধুনিক যুগে মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এলেও বদলায়নি তার জীবনযাত্রা। ৪০ বছর ধরে ঘানিতেই আটকে আছে সুফিয়া বেগমের জীবন।
সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, সুফিয়া বেগমের বাবা পেশায় একজন তেল বিক্রেতা ছিলেন। সেই সুবাদে বাবার সঙ্গে ঘানি ঘুড়ানোর কাজে সহযোগিতা করতেন তিনি। চল্লিশ বছর আগে জোত আতাউল্লাহ গ্রামের ব্যাপারী বাড়ির ছেলে রজব আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। সংসারের হাল ধরতে স্বামীর বাড়ি এসেও ঘানি টানতে হয় তাকে। এরই মধ্যে ৯ মাস আগে মারা যান স্বামী রজব আলী। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি তিনি। তিন মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়েছে। এক ছেলে পোশাক কারখানায় কর্মরত এবং আরেক ছেলে বউ নিয়ে আলাদা থাকে।
প্রযুক্তির যুগে এসেও এমন অমানবিক কাজ চালিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সুফিয়া বেগম জানান, ছেলেমেয়ে কেউ তাকে দেখাশোনা করেন না, অভাবের সংসারে দুবেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার জন্য এই কাজ করছেন তিনি। মেশিন বা গরু কিনে এ কাজ করার সামর্থ্য তার নেই।
চল্লিশ বছর ধরে ঘানি টানায় কোনো ধরনের অসুস্থতায় ভুগছেন কি না জানতে চাইলে সুফিয়া বেগম জানান, এমনিতে বড় কোনো অসুখ না হলেও সারা দিন ঘানি টানায় রাতে বুকের ব্যথায় ঘুমাতে পারেন না।
আয় কেমন হয় জানতে চাইলে সুফিয়া বেগম জানান, দৈনিক ১৫ কেজির মতো সরিষা থেকে চার-পাঁচ কেজি তেল বানানো সম্ভব হয়। পাঁচ কেজি সরিষা ভাঙিয়ে ১২০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়, এ হিসাবে দৈনিক ৩৬০ টাকা পাওয়া যায়।
প্রথম দিকে দুইজন মিলে এই কাজ করলেও, এখন তিনজন দরকার হয়। বাকি দুইজন পার্শ্ববর্তী বাড়ির মহিলাকে সহযোগিতার জন্য নিতে হয়, তিনজনে ভাগ করে নেন মজুরির টাকা ।
কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে কি না জানতে চাইলে সুফিয়া বেগম জানান, একাধিক এনজিও কর্মী এসেছে। আশ্বাস দিলেও কোনো সহযোগিতাই মেলেনি তার ভাগ্যে।
কী ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন জানতে চাইলে সুফিয়া বেগম জানান, এখন ঘানি টানতে কোনোভাবেই তার শরীর উপযোগী নয়। ঘানি ঘুড়ানোর জন্য এক জোড়া ষাঁড় বা বলদ গরু পেলে অমানবিক কষ্ট থেকে মুক্তি মিলবে তার।
পাশের বাড়ির কমলা বেগম জানান, সময় পেলে তাকে সহযোগিতা করি, বিয়ে হওয়া থেকে দেখতাছি সে এ কাজ করে। সরকার থেকে যদি তাকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করা হতো তাহলে একটু পেটের ভাতের ব্যবস্থা করতে পারত।
মান্না নামে এক স্কুলছাত্র বলে, পড়াশোনার পাশাপাশি তাকে সহযোগিতা করি। তার কষ্ট দেখলে চোখে পানি চলে আসে। সেই ৪০ বছর ধরে শুনতাছি তিনি এ কাজ করেন। ইউএনও স্যারের কাছে দাবি একটাই, তাকে যেন একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন।
আফসার আলী নামে একজন জানান, আমার বয়স ৬০ বছর। রজব আলীর ঘরে বিয়ের পর থেকে দেখতাছি সে এই কাজ করে। রজব আলীর সন্তান থাকলেও সেই সন্তানেরা তাকে দেখাশোনা করে না। সরকার যদি কোনো সহযোগিতা করে তাহলে ভালো হতো।
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ মল্লিক বলেন, ‘বিষয়টি জানা ছিল না। খুবই অমানবিক একটা বিষয়। সুফিয়া বেগমের জন্য শিগগিরই একটা ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
টিআর/এম. জামান