
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১, ১২:১৮ পিএম
মো: লিটন হোসেন লিমন, নাটোর প্রতিনিধি
ইতিহাসখ্যাত ঐতিহ্যপূর্ণ পর্যটন স্থান হিসেবে পরিচিত নাটোরের 'উত্তরা গণভবন'। ঢাকার বাহিরে
প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় বাসভবন হিসেবে ‘উত্তরা গণভবন’
পরিচিত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি নাটোরে সফরে
এসে দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তারপর ১৯৭৪ সালে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সপরিবারে এ গণভবনে সফরে আসেন।
গণভবনটি ৪৪ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। বিশালাকার এ গণভবনে রয়েছে দিঘি, বাগান, ইটালিয়ান গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, নতুন সংগ্রহশালাসহ দেশ-বিদেশের বাহারি রকমের গাছ। পুরো গণভবনের চারপাশে উঁচু দেয়াল দ্বারা ঘেরা। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে পর্যটকরা আসেন এই গণভবনে। গণভবনের প্রকৃতি-সৌন্দর্য পর্যটকদের এতটাই আকর্ষণ করে যে গণভবনে প্রবেশ করলে সহজে বের হতে চান না তারা।
নাটোর শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার উত্তরে দিঘাপতিয়া এলাকায় ‘উত্তরা গণভবন’ অবস্থিত। বর্তমানে এ গণভবনটি জনপ্রিয় এক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। এ গণভবন প্রাঙ্গণে আছে ইতালি থেকে সংগৃহীত মনোরম ভাস্কর্যে সজ্জিত বাগান। যেখানে রয়েছে বিরল প্রজাতির নানা উদ্ভিদ।
গণভবনের ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হরেক রকমের ফুল ও ঔষধি গাছ। সামনের মাঠে ফুটেছে দৃষ্টিনন্দন গাঁদা ও গ্লাডিওলাস ফুল। গণভবনে ঢুকলেই যেন পর্যটকদের ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাস দিয়ে অভ্যর্থনা জানায়। অন্যদিকে দর্শানার্থীরাও গণভবনে ঢুকেই আগে ফুলের কাছে গিয়ে তুলেন ছবি।
গণভবনের ইতিহাস:
নাটোরের রানী ভবানী তার নায়েব দয়ারামের ওপরে সন্তুষ্ট হয়ে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে। এরপর ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজপ্রাসাদটি পরিত্যক্ত থাকে।
১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এ ভবনটিকে সরকারি প্রাসাদের হিসেবে এর সংস্কার করে। চারদিকে মনোরম লেক, সুউচ্চ প্রাচীর পরিবেষ্টিত ছোট-বড় ১২টি কারুকার্যখচিত ও দৃষ্টিনন্দন ভবন রয়েছে। যা আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘উত্তরা গণভবন’। সেই সময়ের বাংলার রাজা-জমিদারদের মধ্যে দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। দয়ারাম রায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
১৬৮০ সালে নাটোরের প্রখ্যাত কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে দয়ারাম রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিলেন নরসিংহ রায়। নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের অধীনে চাকরি করতেন সে সময়ে তিনি কাজ উপলক্ষে চলনবিল এলাকার কলম গ্রামে পৌঁছান। রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ন ঠাকুরের অধীনে কর্মচারী ছিলেন তখন দয়ারাম তার মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকরি করতেন। পরে সামান্য লেখাপড়া করে জমা খরচ রাখার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন। রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনে নিযুক্ত করেন।
পরবর্তীতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের স্নেহ, ভালোবাসা ও সহানুভূতি পেতে থাকেন তিনি। বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের প্রিয়ভাজন হওয়ায় দয়ারাম জমিদারি লাভ করেন। প্রথমে রাজা রামজীবনের একজন সাধারণ কর্মচারী থাকলেও প্রতিভা, দক্ষতা আর বিশ্বস্ততা দিয়ে নাটোর রাজের দেওয়ান পর্যন্ত হয়েছিলেন দয়ারাম। রাজা রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম রায় নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
যশোহরের রাজা সীতারাম রায় বিদ্রোহী হলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাটোর রাজের দেওয়ান দয়ারামের সাহায্যে তাকে দমন ও পরাজিত করে নাটোর কারাগারে বন্দি করে রাখেন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করায় নবাব সরকারে দয়ারামের প্রভাব বেড়ে যায় এবং তিনি ‘রাই রাইয়া’ খেতাবে ভূষিত হন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করে তিনি মূল্যবান সম্পদসমূহ লুন্ঠন করেন।
তবে সীতারামের গৃহদেবতা কৃষ্ণজির মূর্তি ছাড়া সব রামজীবনের হাতে অর্পণ করেন। দয়ারামের এহেন ব্যবহারে রামজীবন খুশি হয়ে দয়ারামকে কৃষ্ণজির মূর্তি স্থাপনের জন্য পুরস্কার স্বরূপ দিঘাপতিয়ায় একখণ্ড জমি দান করেন। সেই সাথে বর্তমান বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা এলাকার নওখিলা পরগনাও দান করেন।
এটিই দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রথম জমিদারি। পরে তিনি লাভ করেন পরগনা ভাতুরিয়া তরফ নন্দকুজা, যশোহরের মহল কালনা ও পাবনা জেলার তরফ সেলিমপুর। এভাবে দিঘাপতিয়া রাজবংশের ও জমিদারির গোড়াপত্তন ১৭৬০ সালে হয়। বর্তমানে এই রাজপ্রাসাদ থেকে হারিয়ে যাওয়া রাজা-রানির ব্যবহৃত ঐতিহাসিক সব নিদর্শন উদ্ধার করে একটি সংগ্রহশালা নির্মাণ করা হয়েছে।
উত্তরা গণভবন পরিদর্শনের সময়:
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উত্তরা গণভবন দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। শীতকালে ৫টায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সপ্তাহের প্রতি রোববার উত্তরা গণভবন বন্ধ থাকে। গণভবনের আঙিনায় প্রবেশ করতে জনপ্রতি ২০ টাকা মূল্যের টিকেট ক্রয় করতে হয়।
উত্তরা গণভবনে যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে নাটোর যাওয়ার বেশ কিছু বাস সার্ভিস রয়েছে। এদের মধ্যে- গ্রিন লাইন, হানিফ, দেশ, শ্যামলী এবং ন্যাশনাল পরিবহন উল্লেখযোগ্য। এসব পরিবহনের বাসগুলো নিয়মিতভাবে ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। বাসভেদে জনপ্রতি টিকেটের মূল্য নন-এসি ৩৮০ টাকা এবং এসি ৬০০ টাকা। নাটোর বাসস্টপ কিংবা রেলস্টেশন থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উত্তরা গণভবন যেতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগে।
টিআর/ডাকুয়া