প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১, ০৪:২৮ পিএম
তাহজীবুল আনাম, কক্সবাজার প্রতিনিধি
পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী মাতামুহুরী। বান্দরবানের আলীকদম পাহাড় থেকে
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বদরখালী সমুদ্র চ্যানেল পর্যন্ত এই নদীর আয়তন ১৪৮ কিলোমিটার।
বন্যা ও জোয়ারের পানির কবলে পড়ে নদীর উত্তর পাশে প্রতি বছরই বিলীন হয় ঘরবাড়ি ও ফসলি
জমি। ভাঙনের তীব্রতায় হারিয়ে যায় জনপদ।
চলতি
মৌসুমে এরই মধ্যে বহু ঘর ও ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। ঘরবাড়ি হারানো অনেক পরিবার
ভূমিহীন হয়ে বর্তমানে নিঃস্ব। চলমান বর্ষায় ভাঙন এবং নদীতে বিলীন হওয়ার পথে অন্তত ২০টি
গ্রাম। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদ-মাদরাসাও।
প্রায়
তিন কিলোমিটার এলাকার ভাঙন রোধে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড
বরাবর আবেদনও করেছেন এলাকাবাসী। আবেদনে সুপারিশও করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম।
আবেদন
সূত্রে জানা গেছে, চকরিয়া কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব সীমানা থেকে
৯ নম্বর ওয়ার্ডের দ্বীপকুলপাড়া পুরনো কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পর্যন্ত ব্যাপক ভাঙন দেখা
দিয়েছে। সম্প্রতি বন্যায় পাঁচটি ঘর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। ক্ষতি হয়েছে কৃষি জমি ও
ফসলের। হুমকিতে রয়েছে দ্বীপকুল পাড়া, ছোঁয়ালিয়া পাড়া, ধুপি পাড়া, শীল পাড়া, টুনু সিকদার
পাড়া, কৈয়ারবিল প্রপার, মুহুরী পাড়া, মিয়াজী পাড়া, চড়ারকুল, জালিয়া পাড়া ও হিন্দু পাড়া।
এসব এলাকায় রয়েছে কৈয়ারবিল উচ্চবিদ্যালয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের
মাকজুলুলুম মাদরাসা, আলহেরা মসজিদ ও এবতেদায়ি মাদরাসা, পশ্চিম কৈয়ারবিল সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। চলমান বর্ষা ও বন্যায় এসব এলাকা ও মসজিদ-মাদরাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো
ভাঙনের কবলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ
ছাড়া লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চরপাড়ার পূর্ব সীমানা থেকে ৪ নম্বর ওয়ার্ড
রোস্তম আলী চৌধুরী পাড়া পর্যন্ত সম্প্রতি বন্যায় ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে
রোস্তম আলী চৌধুরী পাড়া, ২ নম্বর ওয়ার্ডের জালিয়া পাড়া, ১ নম্বর ওয়ার্ডের মণ্ডল পাড়া
পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত নদী ভাঙনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকের ফসলি জমি ও গোয়ালঘর নদীতে
বিলীন হয়েছে।
খোঁজ
নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি বন্যায় মাতামুহুরী নদীতে বিলীন হয়ে যায় কৈয়ারবিল ৯ নম্বর
ওয়ার্ডের দ্বীপকুল এলাকার শিব্বির আহমদ, সোনা মিয়া, কামাল হোসেন, রোকেয়া বেগম, মো.
হোসেন, মনজুর আলম, নুর নাহার ও মো. মানিকের বসতবাড়ি। নদীতে ভিটা ও বাড়ি হারিয়ে তারা
এখন নিঃস্ব।
বসতভিটা
হারানো শিব্বির আহমদ সিটি নিউজ ঢাকাকে জানান, প্রতি বছর বন্যায় মাতামুহুরীর উত্তর পাশ
ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বসতবাড়ির পাশাপাশি ভেঙে যায় অনেক ফসলি জমিও। সম্প্রতি বন্যায়
তার ঘরসহ প্রায় ১০টি বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়। এখন পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এক আত্মীয়ের
বাড়িতে। নদীর তীরে স্থায়ী কোনো বাঁধ না দেয়ায় বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন কৈয়ারবিল ইউনিয়নের
মানুষ।
ভুক্তভোগী
মো. হোসেন বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে আমার অনেক আত্মীয়স্বজন নদীতে বসতঘর হারিয়ে অন্যত্র চলে
গেছেন। এই বছর আমার ঘর বিলীন হয়েছে। একই সঙ্গে ফসলি জমিও রক্ষা পায়নি। সব হারিয়ে এখন
আমি নিঃস্ব। দ্রুত সময়ে জিও ব্যাগ স্থাপন না করলে আমার মতো অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে
যাবে।’
গত
কয়েক বছরে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে শুধু দ্বীপকুল এলাকা থেকে অন্যত্র চলে যান নুর আহমদ,
রফিক আহমদ, ইসহাক মিয়া, আবুল কালাম, ঠিকাদার নজির আহমদ দিদার, শাহাব উদ্দিন ও আব্দুল্লাহ
আল নোমানসহ বহু পরিবার। এখনও তারা নদী ভাঙনের আতঙ্কে রয়েছেন।
দ্বীপকুল
এলাকার বাসিন্দা ঠিকাদার ও সমাজসেবক নজির আহমদ দিদার সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘কয়েক
বছর আগে আমার বসতভিটাও নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এরপর নদীর তীর থেকে একটু দূরে এসে ঘর তৈরি
করি। কিন্তু এখনও দুশ্চিন্তা যায়নি। চলমান বর্ষা ও সম্প্রতি বন্যায় নদীর তীর ভেঙে আবারও
বাড়ির পাশে চলে এসেছে। এখন নতুন করে আতঙ্কে আছি।’
তিনি
আরও বলেন, ‘সম্প্রতি বন্যায় অনেক ঘর ও ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। দ্বীপকুল পুরাতন কেন্দ্রীয়
জামে মসজিদও বিলীন হওয়ার পথে। প্রায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয় করে গত বছর মসজিদের কাজ শেষ হয়েছে।
এখন মসজিদের দক্ষিণ পাশের বাউন্ডারি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ধসে পড়েছে। যেকোনো সময় পুরাতন
মসজিদসহ দ্বীপকুল বাজার, নতুন নতুন বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলীন হতে পারে। দ্রুত
সময়ে যদি জিও ব্যাগ স্থাপন করা যায়; তাহলে অনেক গ্রাম রক্ষা পাবে।’
চকরিয়া
৯ নম্বর লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কাইছার বলেন, ‘সম্প্রতি
বন্যায় নদী ভাঙনে আমার ইউনিয়নের প্রায় ১০টির মতো বসতঘর বিলীন হয়েছে। এ ছাড়া আধা কিলোমিটার
ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। হুমকিতে রয়েছে আরও বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ব্লক স্থাপনের
মাধ্যমে যদি স্থায়ী বাঁধ দেয়া যায়, তাহলে রক্ষা পাবে অনেক গ্রাম।’
তিনি
আরও বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের চার গ্রামের বাসিন্দারা বেশি আতঙ্কে রয়েছেন। দ্রুত সময়ে জিও
ব্যাগ স্থাপনের মাধ্যমে গ্রাম রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বরাবর আবেদনও করা হয়েছে।’
এ
বিষয়ে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন,
‘সম্প্রতি বন্যায় মাতামুহুরীর যেসব এলাকায় পানি ছিল এবং বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল সব জায়গা
পরিদর্শন করেছি ও মনিটরিংও করা হয়েছে। তাছাড়া পানি কমে না যাওয়ায় কাজ শুরু করতে পারিনি।
যে চারটি জায়গায় ভেঙে গিয়েছিল, বর্তমানে সেখানে জিও ব্যাগ দিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।’
তিনি
আরও বলেন, ‘চকরিয়া পৌর রক্ষা বাঁধের আর দুটি জায়গায় কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন
জায়গায় ভাঙন এখনও সীমারেখার মধ্যে রয়েছে। বর্ষাকাল এখনও চলমান থাকায় আমরা মনিটরিংয়ে
রেখেছি। যে জায়গায় ভাঙন বেড়েছে বা নতুন করে ভাঙন হয়েছে, সবগুলো অন্তর্ভুক্ত করে সমীক্ষা
শেষ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ভাঙন রোধে প্রতিরক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন করতে প্রকল্প সাবমিট
করা হয়েছে।’
টিআর/সবুজ/এম.
জামান