• ঢাকা রবিবার
    ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

সেই জিয়া দেশেই আছে !

প্রকাশিত: মে ১৫, ২০২৩, ০৫:৪২ পিএম

সেই জিয়া দেশেই আছে !

ছবি: সংগৃহীত

ইমরান আলী, ঢাকা

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি নেতা সেনাবাহিনী থেকে বহিস্কৃত জিয়া ওরফে মেজর জিয়া আবারো আলোচনায় এসেছেন। জঙ্গি সংক্রান্ত যে কোনো ঘটনা ঘটলেই চলে আসে তার নাম। পুরস্কার ঘোষিত এ জঙ্গিকে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম, নব্য জেএমবি সর্বশেষ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াতেও তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পায় র‌্যাব।

জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ মায়মুনের বাসায় যাতায়াত ছিল মোস্ট ওয়ানটেড এ জঙ্গির। এর আগে ঢাকার আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা পায় গোয়েন্দারা। এছাড়াও ব্লগার, মুক্তমনা, প্রকাশকসহ  ভিন্ন মতাবলম্বী হত্যার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড এই জিয়া। বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়েও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। অথচ ফাঁসির দণ্ড নিয়ে ঘুরছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। খোদ রাজধানীতেও এসেছেন কয়েকবার।  

সিটিটিসির ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাহমুদুল হাসান বলেন, এটা বলা খুব কঠিন। তিনি দেশে আছেন নাকি দেশের বাইরে আছেন সেটা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। তবে বিভিন্ন অ্যাকটিভিজ, তথ্য-উপাত্ত বলে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারেনি। ধারণা করা যায় দেশেই আছে। আমরা জানি আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান মেজর জিয়া। তিনি (জিয়া) সরব থাকতে যেভাবে অপারেশন হতো, এখনকার কর্মকাণ্ডের ধরণও একই রকম। সেক্ষেত্রে মনে হয় জঙ্গি ছিনতাইয়ের ডিরেকশনও একই। সেটা আমলে নিলে মেজর জিয়া দেশেই আছে অনুমাণ করা যায়।

র‌্যাব সূত্র জানায়, সিলেট থেকে গ্রেপ্তার নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার দাওয়াতি শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ মায়মুনের বাসায় যাওয়া-আসা ছিল আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার।

গত সোমবার রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা দল ও র‌্যাব-৯-এর যৌথ অভিযানে সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার বড়শলা বাজার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন মায়মুন। তার বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলায়।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার মায়মুন ২০১৩ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। তিনি সংগঠনের সিলেট বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং তার সিলেটের বাসায় জিয়ার যাতায়াত ছিল। ২০১৯ সালে বগুড়ার একটি সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় গ্রেপ্তার হন এবং এক বছরের বেশি কারাভোগ করে ২০২০ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্তি পান মায়মুন।

র‌্যাব জানায়, মায়মুনের নেতৃত্বে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন শরক্বীয়াকে নতুন করে সংগঠিত করার পরিকল্পনা হচ্ছিল। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের কারণে বর্তমানে তারা ছন্নছাড়া অবস্থায় রয়েছে। তাই এর পূর্ববর্তী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিল শরক্বীয়ার সদস্যরা। জঙ্গি মায়মুন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে শারক্বীয়ার সেতুবন্ধনে কাজ করছিলেন। তার বাসায় কয়েকবার জিয়া আসা যাওয়া করেছেন। এমনকি শারক্বীয়াকে ১৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন জিয়া।

এর আগে ঢাকার নিম্ন আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পর নতুন করে আলোচনায় আসে এই জিয়া। গতবছরের ২০ নভেম্বর দুপুরে দুই জঙ্গিকে একটি মামলায় আদালতে হাজির করা হয়। হাজিরা শেষে পুলিশ সদস্যরা তাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন হাজত খানার দিকে। এ সময় পুলিশের চোখে-মুখে স্প্রে করে জঙ্গি সদস্য মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। এই দুই জঙ্গি দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। দীর্ঘ পরিকল্পনায় তাদের প্রকাশ্য আদালত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। এ ঘটনার পেছনে থেকে জিয়াই কলকাঠি নেড়েছেন বলে গোয়েন্দাদের নিকট প্রমাণ আসে।

নয়টি হত্যার ‘মূল পরিকল্পনায়’ জিয়া : ২০১৩-২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন এমন দুজনকে হত্যা করেছে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটি। এই সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হত্যার পেছনেও ছিল তারা। এসব ঘটনার তদন্ত করে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জিয়ার নাম উঠে এসেছে।

২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দুজনকে হত্যা করে এবিটির স্লিপার সেলের সদস্যরা। তারা দুজনই সমকামীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতেন। একই বছরের ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অদূরে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, রাজধানীর গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ওই বছরের শেষ দিকে আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে হত্যা করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনকে। এর আগে ২০১৩ সালে রাজধানীর পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার।


আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য বলছে, মেজর জিয়ার তত্ত্বাবধানে এবিটির অন্তত আটটি স্লিপার সেল তৈরি হয়। প্রতিটি সেলের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচজন। সেই হিসাবে অন্তত ৩০ জন দুধর্ষ ‘স্লিপার কিলার’ জঙ্গি তৈরি করেছেন তিনি। তারাই ব্লগার, প্রকাশক, মুক্তমনা ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করেছে।

এসব ঘটনায় অভিযুক্ত ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি জিয়াকে ধরতে গত দশ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে কয়েকবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার সন্ধান পেয়েছে দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাকে ধরতে ২০ লাখ টাকা পুরষ্কারও ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন আইজিপি শহীদুল হক।

সিটিটিসি’র একাধিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, জিয়া গত বছর ঢাকার গুলিস্তানের আহাদ পুলিশ বক্সের পেছনে তার সংগঠনের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন। সেই ব্যক্তিও জানতেন না, টাকা নিতে আসা ব্যক্তিই জিয়া। টাকা দেওয়া ওই ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও ধরা যায়নি জিয়াকে। ২০১৯ সালে ঈদুল ফিতরের আগে চট্টগ্রামে রেলের টিকিটও কাটেন তিনি। ঢাকার মোহাম্মদপুর ও বাড্ডায় থেকেছেন দীর্ঘদিন। টঙ্গিতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানেও হাজির হয়েছিলেন। ময়মনসিংহে আরেক জঙ্গির বাড়িতে ছিলেন কয়েক মাস।

২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে অন্যতম এই মেজর জিয়া। সে সময় বেশ কয়েকজন ধরা পড়লেও পালিয়ে যান তিনি। তিনি পলাতক থেকেই দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিস্তারে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করছেন।

জানা যায়, জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। তার বাবার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ জিল্লুল হক। গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুরে। আত্মগোপনে যাওয়ার আগে মিরপুর সেনানিবাসে থাকতেন।

 

 

আর্কাইভ