• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০৭ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১
গোদাগাড়ির শতাধিক নারীর অন্ধকার জীবন

১০ সীমান্ত দিয়ে দেশে আসছে হেরোইন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩, ১১:৫৬ পিএম

১০ সীমান্ত দিয়ে দেশে আসছে হেরোইন

ছবিঃ সিটি নিউজ ঢাকা

ইমরান আলী, ঢাকা

চোরাচালান ব্যবসা পরিচালনার জন্য  সব শ্রেণীর মানুষকে ব্যবহার করে গোদাগাড়ীর গডফাদাররা। তারা হিসেব করে স্থান বুঝে কাজে লাগিয়ে দেয়। বিশেষ করে মেয়েদের উপর। এমনি একজন হলো কলেজ ছাত্রী মুক্তি । যে সবে মাত্র স্কুল পেরিয়ে কলেজে পা রেখেছে। দেখতে  সুন্দরী। সাংস্কৃতিক মনা টিনেজ মুক্তির ওপর টার্গেট করে সফলও হয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। নানা কৌশলে এদের অবৈধ ব্যবসায় কাজ করতে রাজি করে,  মুক্তিও সেই ফাঁদে পড়া একজন। 

মাস চারেক আগে ৩০০ গ্রামের একটি চালান পাচারের সময় র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে মুক্তি। এ দেখে  হতভম্ব হয়ে যায় মুক্তির পরিবার। তার পিতা উপজেলা মৎস্য অফিসের অফিস সহকারী।মুক্তি আটকের পর তার পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার।  মুক্তি এখন কারাগারে। মুক্তি জেলে যাওয়ার পর তার  মা  শোকে পাথর হয়ে গেছে। গোদাগাড়ি থানার ঠিক দক্ষিণপাশে রামনগর এলাকা। ঠিক পদ্মার তীর ঘেঁষে বাড়ি।  সেখানেই  কথা হয় মুক্তির মা মনোয়ারার সঙ্গে। 


তিনি বলেন, ‘ ফিশারিজ মোখলেসের পরিবার (মুক্তির বাবা) কেমন কে না জানে। কিন্তু মেয়ে এ রকম হবে কল্পনাতেও ছিলনা। কারা নষ্ট করলো -এ কথা বলেই দুই চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।
তিনি বলেন, ‘কারা নষ্ট করলো আমার মেয়েকে আমি তাদের বিচার চাই। মেয়ে তো আমার এরকম ছিলনা। কেন এমন হলো?
রাজশাহী শহর থেকে ৩০/৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলা।  সীমান্ত ঘেঁষা উপজেলাটি যেমন কৃষি পণ্যের জন্য বিখ্যাত তেমনি মাদক তথা মরন নেশা হেরোইনের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। কক্সবাজারের টেকনাফে যেমন নদীর স্রোতের মত ইয়াবা দেশের অভ্যন্তরে আসে ঠিক তেমনি উপজেলার অন্তত ১০ টি সীমান্ত গলিয়ে হেরোইন দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। গোদাগাড়ী তারই একটি। এখানে  শতকরা ৯০ ভাগ হেরোইন  সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসে। আর হেরোইনের গডফাদাররা তা পাচারের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করে। তাদের পাতা ফাঁদ থেকে নারী, শিশু এমনকি স্কুল ছাত্রীও বাদ যায়নি। হেরোইনের এ ফাঁদে পড়ে বহূ পরিবার  তছনছ হয়ে গেছে অন্যদিকে সমাজ তথা লোকজনের নিকট হয়ে গেছে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে।  বছরের পর বছর জেলে খেটে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেও পারেনি অনেকে। তারপরও কারবারীরা নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে নারীদের বাহক হিসেবে  ব্যবহার করছে। আর এতে করেই তাদের জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার। 


স্বামী হারা সংসার চালাতে যখন হিমসিম খাচ্ছিলেন এ সময় স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নেন একই গ্রামের সুলতানা। ঋণের কিস্তি পরিশোধে করতে তাকে বাধ্য হতে হয়েছে অবৈধ মাদক বাহকের কাজে নিজকে জড়াতে। আর এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। কঠিন সময়ে  প্রস্তাব পান হেরোইন পাচারের। অন্যায় এবং বিপজ্জনক হওয়া সত্বেও রাজি হয়ে যান তিনি। পরে হেরোইন নিয়ে রাজশাহী থেকে রংপুরে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়ে যান। বর্তমানে কারাগারে থাকা সুলতানার বাড়িতে গেলে দেখা মেলে তার ছেলে বাপ্পির। 


মাদক ব্যবসায়ী সুলতানা

বাপ্পি জানায়, সংসারে ঋণের টাকা কিস্তি পরিশোধের জন্য তাদের সমস্যা হচ্ছিল। এ কারণে মা এ কাজে জড়িয়েছে। নগদ টাকার জন্যই অন্যায় জেনেও মা রাজি হয়ে যায়।  মা বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এখন বুঝছি মায়ের এ কাজে জড়ানো ঠিক হয়নি। মায়ের মামলা চালাতেও আমরা হিমসিম খাচ্ছি। 
সুলতানগঞ্জের মুক্তিরও অবস্থাও ছিল একই রকম। লোভের বশবর্তী হয়ে কারবারে জড়িয়ে তিনিও কারাগারে। মুক্তি কিংবা সুলতানায় নয়, গোদাগাড়িতে প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ কেউ  কারাগারে কেউবা  জামিনে রয়েছেন।


এই এলাকার কারবারীরা আড়ালে থেকে নানা প্রলোভন কিংবা ফাঁদে ফেলে ভয়ঙ্কর রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছে। আর এতে করেই একসময়ের সুশৃঙ্খল জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার। 
হেরোইন আসা ১০ সীমান্ত : উপজেলার ১০ টি সীমান্ত দিয়ে দিনে রাতে হেরোইন আসে বলে জানা যায়।এসব মাদক পদ্মায় মাছ ধরা নৌকা কিংবা চর এলাকায় মোটরসাইকেল ব্যবহার করে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে  আনছে। এ সীমান্তগুলো হলো মহিষালবাড়ি, বিদিরপুর, বখচর, চর আষাড়িয়াদহ, চর অনুপনগর, দেবিনগর, ফুলতলা, কামারপাড়া, সুলতানগঞ্জ, রেলবাজার ঘাট।  


লোকজন বলছেন, কারবারীরা টাকা লাগিয়ে বসে থাকে। বাকি কাজগুলো  করে তাদের এজেন্টরা। সীমান্তের ওপার থেকে এপারে আনতে একজন দ্বায়িত্বে থাকে। আবার এপারে আনার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচারের জন্য থাকে অন্য এজেন্ট। আর এই এজেন্টরা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্তে পাচার করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে অত্যন্ত সুকৌশলে তারা এ কাজ করছে। কিন্তু র‌্যাব পুলিশের অতি সতর্কতার ফলে তারা ধরাও পড়ে যায়। 
জানা যায়, ১০০ গ্রাম হেরোইন গোদাগাড়ি থেকে রাজশাহী পর্যন্ত পৌঁছালে ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়।  ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে যেতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বাহককে দেয়া হয়। নগদ টাকার  লোভে পড়েই নারী, শিশুসহ অন্যরা এ কাজে জড়িয়ে পড়ছে।  


স্থানীয় শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, আমরা এখন নিজেদের গোদাগাড়ি এলাকার বাসিন্দা বলতে লজ্জা করি। বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, ভালো আর কে মাদক ব্যবসায়ী এটা নির্ণয় করা কঠিন। একজন স্কুল শিক্ষক হয়েও অনেক সময় আমাকে তল্লশির আওতায় পড়তে হয়। এটা আমার জন্য লজ্জার ।

তিনি বলেন, এটি খুবই উদ্বেগের যে, এখন গৃহবধু থেকে শুরু করে স্কুলের ছাত্রীরাও এ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে। আসলে টাকা কামানোর প্রতিযোগীতায় কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় কিছুই দেখা হচ্ছেনা।
রেজাউল করিম বলেন,  আসলে আমাদের মধ্যে ধর্মের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। ধর্মের চেতনা জাগ্রত হলেই কেবল এসব অন্যায় বেআইনী কাজ বন্ধ হবে। 


এদিকে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মাসুদ হাসান বলেন, নারীরা যে এমন কাজে জড়াচ্ছে এটি উদ্বেগের। তবে যার কাছেই পাওয়া যাবে আমরা তাদেরই গ্রেফতার করবো এবং আইনের আওতায় আনবো। 
তিনি বলেন, শুধু বাহক নয়, মূল কারবারীকেও আমরা গ্রেফতার করছি।

 

এসএএইচ/

আর্কাইভ