প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২২, ০৪:১২ এএম
পুলিশ অধিদফতর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আয়ুবকে। তাকে সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক, পুলিশ অধিদফতর থেকে ৬ এপিবিএন মহালছড়ির পুলিশ সুপার করে পাঠানো হয়েছে। গত ২০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখা থেকে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনে এই তথ্য জানানো হয়। খাগড়াছড়ির মহালছড়ি একদম প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল। যেখানে বদলি করা হলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা খুশি হন না। এই জায়গাটি মূলত শাস্তিমূলক বদলির জায়গা বলে চিহ্নিত।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসনের বেশ কিছু কর্মকর্তার কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখা হচ্ছিল। সেই নজরদারির অংশ হিসেবে এই কর্মকর্তাকে পুলিশ অধিদফতর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সিরাজগঞ্জে চাকরিরত থাকাকালীন মোহাম্মদ আয়ুব সার্কেল এএসপির নোট বইতে কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বমূলক এন্ট্রি করেন। যা তৎকালীন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল এ কে এম শহীদুল ইসলামের দৃষ্টিগোচর হয়।
মোহাম্মদ আয়ুব সেই কর্মকর্তা- যার বিরুদ্ধে গত নির্বাচনে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ব্যাপক হয়রানির অভিযোগ ওঠে। সে সময় তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার সার্কেল এএসপি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। শুধু দলীয় নেতাকর্মীরাই নয়, তার জুলুম থেকে রেহাই পায়নি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো। নিস্তার পায়নি সাংবাদিকসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষও। ওই এলাকার মানুষ তাকে একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবেই চিনতেন।
জানা যায়, সিরাজগঞ্জে চাকরিরত থাকাকালীন মোহাম্মদ আয়ুব সার্কেল এএসপির নোট বইতে কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বমূলক এন্ট্রি করেন। যা তৎকালীন ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল এ কে এম শহীদুল ইসলামের দৃষ্টিগোচর হয়। পরবর্তীতে এক পর্যালোচনা রিপোর্টে বিষয়টি উল্লেখ করে মতামত প্রদান করেন তিনি।
সার্কেল এএসপি মো. আয়ুব চাকরিতে নবীন। প্রশিক্ষণকাল কম হওয়ায় বিভাগীয় কাজকর্মে তার জ্ঞানের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তিনি সার্কেল এএসপির নোট বইতে অহেতুক ও পক্ষপাতিত্বমূলক কিছু এন্ট্রি করেছেন। যা বিধিসম্মত নয়।
রিপোর্টে এ কে এম শহীদুল ইসলাম লেখেন, ‘সার্কেল এএসপি মো. আয়ুব চাকরিতে নবীন। প্রশিক্ষণকাল কম হওয়ায় বিভাগীয় কাজকর্মে তার জ্ঞানের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তিনি সার্কেল এএসপির নোট বইতে অহেতুক ও পক্ষপাতিত্বমূলক কিছু এন্ট্রি করেছেন। যা বিধিসম্মত নয়। তাকে বিভাগীয় কাজকর্মে দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে আরও উদ্যোগী হতে এবং ভবিষ্যতে সতর্কতার সঙ্গে পবিত্র মন নিয়ে নিরপেক্ষভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পরামর্শ দেয়া হলো।’
তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কর্মরত স্থানীয় প্রবীণ সাংবাদিক দীপক কর সমন্ধে মোহাম্মদ আয়ুব সার্কেল এএসপির নোট বইতে লেখেন, ‘দীপক করের সাংবাদিকতা করার তেমন কোনো যোগ্যতা নেই। তিনি এলাকায় হলুদ সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। তিনি সংবাদ ছাপানোর নামে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সুবিধা নিয়ে থাকেন। ২০০৭ সালে তার বিরুদ্ধে তাড়াশ থানায় একটি নারী নির্যাতন মামলা হয়। কল্পনা আইন্দ নামক এক কিশোরী মেয়েকে অপহরণের পর আশ্রয় দান ও অপহরণে সহযোগিতা করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেয়া হয়। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে দীপক কর স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নিয়ে পত্রিকায় মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদন ছাপে। হলুদ সাংবাদিক হিসেবে সমগ্র রায়গঞ্জ এলাকায় দীপক করের নাম উল্লেখযোগ্য। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে তার সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। সে একজন প্রশাসন বিরোধী লোক।’
শুধু সাংবাদিক দীপক করই নয়। স্থানীয় রাজনীতিবিদ সেলিম জাহাঙ্গীর, তার ভাই সাইদুল ইসলাম, রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেনসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বমূলক এন্ট্রি করেন মোহাম্মদ আয়ুব।
সার্কেল এএসপির নোট বইতে মোহাম্মদ আয়ুবের এমন এন্ট্রির সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে সিটি নিউজ ঢাকা। কথা হয় এই পুলিশ কর্মকর্তার নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে। তারা সবাই জানান, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে মোহাম্মদ আয়ুবের ক্ষমতা অপব্যবহারের কাহিনী। মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো গর্হিত অভিযোগও পাওয়া যায় এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তার এসব কর্মকাণ্ডের কারণে রায়গঞ্জে এক ছাত্রদল নেতার হাতে বেদম মারও খেয়েছিলেন তিনি।
অনৈতিক সুবিধা নিয়ে মোহাম্মদ আয়ুবের ক্ষমতা অপব্যবহারের কাহিনী। মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো গর্হিত অভিযোগও পাওয়া যায় এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তার এসব কর্মকাণ্ডের কারণে রায়গঞ্জে এক ছাত্রদল নেতার হাতে বেদম মারও খেয়েছিলেন তিনি।
সিটি নিউজ ঢাকার কথা হয় প্রবীণ সাংবাদিক দীপক করের সঙ্গে। ব্রেইন স্ট্রোকের শিকার এই সাংবাদিক এখন অনেকটাই অসুস্থ। তিনি বলেন, ‘আমি সারা জীবনে সততা নিয়ে সাংবাদিকতা করেছি। সহায় সম্বল বলতে কিছুই করতে পারিনি। অসুস্থ হয়ে নিজের ভিটেবাড়ির তিন শতক জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করিয়েছি।’
তার বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে দীপক কর বলেন, ‘২০০৭ সালে কল্পনা আইন্দ নামে এক সংখ্যালঘু আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণের শিকার হন। পরবর্তীতে থানায় ধর্ষণের মামলা করতে গেলে ধর্ষকের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে তৎকালীন সার্কেল এএসপি মোহাম্মদ আয়ুব থানাকে মামলা নিতে নিষেধ করেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরেও যখন সেই কিশোরী ধর্ষণের বিচার পাচ্ছিলেন না, এমনকি ধর্ষক গংয়ের হুমকি ধামকিতে থাকতে পারছিলেন না নিজ বাড়িতেও। সে সময় আমিসহ আরও দু-একজন সেই কিশোরীকে আদালতে গিয়ে মামলা করতে সহায়তা করি। এ কারণেই আমরা চক্ষুশুল হয়ে যাই মোহাম্মদ আয়ুবের। পরবর্তীতে আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দেন আয়ুব। নানাভাবে করতে থাকেন হয়রানি।’ পরবর্তীতে সেই মামলাটি আদালতে মিথ্যে বলে প্রমাণিত হয় বলেও জানান এই সাংবাদিক।
থানায় মামলা না নেয়া এবং প্রাণ সংশয়ের অভিযোগ এনে ব্র্যাক এনজিওর আইন ও সালিশ কেন্দ্রে ২০০৭ সালের ৫ আগস্ট সহায়তা চেয়ে আবেদন করেন ভিকটিম কল্পনা আইন্দ। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন থানা মামলা না নেয়ায় আদালতে মামলা করেন তিনি। এরপর থেকে আসামিরা তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে খুঁজছে। প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। সেই আবেদনটিও সিটি নিউজ ঢাকার কাছে সংরক্ষিত আছে।
থানায় মামলা করতে গেলে আমার মামলাও নেয়া হয় নাই। পরে নিরুপায় হয়ে ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জ কোর্টে কামাল পাশা ও তার তিন ভাইয়ের নামে মামলা করি। মামলার পর থেকে আসামিরা আমাকে হত্যা করার জন্য খুঁজছে। আমি প্রাণভয়ে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
আবেদনে কল্পনা আইন্দ বলেন, ‘আমি একজন অতি দরিদ্র আদিবাসী খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মেয়ে, স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলের ছাত্রী। স্কুলে যাওয়া আসার পথে প্রায়শই একই থানার চন্ডিভোগ গ্রামের মৃত আজাহার আলীর ছেলে কামাল পাশা আমাকে ভালোবাসে এবং বিয়ে করবে বলে জানায়। একপর্যায়ে ২০০৭ সালের ৭ জুলাই স্কুলে যাবার পথে আমাকে তার মোটরসাইকেলে তুলে নেয়। আমাকে সিরাজগঞ্জ রোডের একটি হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে আমরা খাওয়া-দাওয়া করি। এরপর একটি বাসে উঠে অপিরিচিত একটি বাসস্ট্যান্ডে এসে আমাকে নিয়ে নামে, তখন প্রায় রাত ৯টা বাজে। আমি বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলে সে আমাকে বুঝায় বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। বেশ কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর একটি ফাঁকা স্থানে পৌঁছলে কামাল পাশা আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। আমি রাজি না হলে সে একটি ছুরি বের করে এবং চেচামেচি করলে আমাকে মেরে ফেলবে বলে জানায়। আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাই। সেই সুযোগে কামাল পাশা আমাকে জোড়পূর্বক ধর্ষণ করে। আমি কান্নাকাটি শুরু করলে সে আমাকে বিয়ে করবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়িতে রেখে আসে। ফলে আমার বাড়ি ও পার্শ্ববর্তী লোকজন বিষয়টি জেনে যায়।’
কল্পনা আইন্দ বলেন, ‘এ ব্যাপারে কামাল পাশার ভাই সাইফুল, জাহাঙ্গীর ও রতনের কাছে বিচার চাইলে তারা কালক্ষেপণ করতে থাকে। মাধাইনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাধন চন্দ্র করের নেতৃত্বে স্থানীয় প্রধানদের নিয়ে সালিশ বৈঠক বসে। সালিশে কামাল পাশা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করলেও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয় না। কামাল পাশার বড় ভাই সাইফুল ও প্রভাবশালী আত্মীয়রা আমাকে বিয়ে দেয়ার কথা বলে এবং ৫০ হাজার টাকা খরচ দিতে রাজি হয়। পরবর্তীতে খরচের টাকা না দিয়ে ধর্ষকপক্ষ সালিশকারীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করে। আমি থানায় মামলা করতে গেলে আমার মামলাও নেয়া হয় নাই। পরে নিরুপায় হয়ে ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই সিরাজগঞ্জ কোর্টে কামাল পাশা ও তার তিন ভাইয়ের নামে মামলা করি। মামলার পর থেকে আসামিরা আমাকে হত্যা করার জন্য খুঁজছে। আমি প্রাণভয়ে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’
সিরাজগঞ্জে থাকাকালীন নিজের অবৈধ উপার্জন বাড়াতে নানারকম অপকর্ম করেন এই কর্মকর্তা। কোনো একটা ইস্যু পেলেই সাধারণ জনগণকে ফাঁসানোর ক্ষেত্রে জুড়ি মেলা ভাড় মোহাম্মদ আয়ুবের।
সাংবাদিক দীপক কর আরও জানান, সিরাজগঞ্জে থাকাকালীন নিজের অবৈধ উপার্জন বাড়াতে নানারকম অপকর্ম করেন এই কর্মকর্তা। কোনো একটা ইস্যু পেলেই সাধারণ জনগণকে ফাঁসানোর ক্ষেত্রে জুড়ি মেলা ভাড় মোহাম্মদ আয়ুবের। তিনি বলেন, ‘কামারগঞ্জের দশশিকা গ্রামে এক যুবক ফসলি জমিতে কীটনাশক স্প্রে করে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে মারা যান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদ আয়ুব ওই পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করে তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করান। সেটাও পরবর্তীতে আদালতে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় এবং মোহাম্মদ আয়ুবকে সতর্ক করেন আদালত।’
মোহাম্মদ আয়ুব চাকরিতে যোগদানের আগে ছাত্রদলের ক্যাডার ছিলেন। আমার কাছে তাকে তেমন ওজনদার অফিসার মনে হয়নি। তিনি আমার প্রতিপক্ষের কাছে অবৈধ সুবিধা নিয়ে আমার ভাইকে মার্ডার কেসে ফাঁসিয়ে গ্রেফতার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগও তুলেছিলেন। পরবর্তীতে সে বিষয়গুলো আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং আমার ভাই বেকসুর খালাস পেয়েছে।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ সেলিম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘মোহাম্মদ আয়ুব চাকরিতে যোগদানের আগে ছাত্রদলের ক্যাডার ছিলেন। আমার কাছে তাকে তেমন ওজনদার অফিসার মনে হয়নি। তিনি আমার প্রতিপক্ষের কাছে অবৈধ সুবিধা নিয়ে আমার ভাইকে মার্ডার কেসে ফাঁসিয়ে গ্রেফতার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগও তুলেছিলেন। পরবর্তীতে সে বিষয়গুলো আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং আমার ভাই বেকসুর খালাস পেয়েছে।’
আমার জামার কলার ধরে এলোপাথারি কিল ঘুষি মারতে থাকে। এ সময় বাজারের লোকজন এগিয়ে এসে তার হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নেয়। তখন এএসপি আয়ুব তার পরিচয় দিয়ে আমাকে শাসায়। বলে, ‘শালাকে বিভিন্ন হত্যা, সন্ত্রাসী, ডাকাতি ও অস্ত্র মামলা দিয়ে ক্রস ফায়ারে দেবো।’
মোহাম্মদ আয়ুবের নানা হয়রানি ও দুর্নীতির বিষয়ে সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, পুলিশ সুপার সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় একাধিক অভিযোগ করেন বিভিন্ন ব্যক্তি। তাদের একজন রায়গঞ্জ থানার পুল্লা গ্রামের আ. কুদ্দুস। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর করা এক আবেদনে তিনি বলেন, “২০০৬ সালের রোজার ঈদের আগের দিন বেলা ১২টার দিকে রায়গঞ্জের নিমগাছী বাজার থেকে সিভিল পোশাক পরিহিত এএসপি মোহাম্মদ আয়ুব এক কাঠমিস্ত্রিকে জামার কলার ধরে মারপিট করতে করতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। বাজারের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা হলে সেই কাঠমিস্ত্রি আমার কাছে উদ্ধারের আকুতি জানায়। আমি তাকে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করায় কাঠমিস্ত্রিকে ছেড়ে আমার জামার কলার ধরে এলোপাথারি কিল ঘুষি মারতে থাকে। এ সময় বাজারের লোকজন এগিয়ে এসে তার হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নেয়। তখন এএসপি আয়ুব তার পরিচয় দিয়ে আমাকে শাসায়। বলে, ‘শালাকে বিভিন্ন হত্যা, সন্ত্রাসী, ডাকাতি ও অস্ত্র মামলা দিয়ে ক্রস ফায়ারে দেবো।’ ঘটনার পরপরই আমাদের ইউনিয়নের বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে বসে বিষয়টির মিমাংসা হয়।”
আবেদনে আ. কুদ্দুস আরও বলেন, “মিমাংসার কয়েকদিন পর এএসপি সার্কেল মোহাম্মদ আয়ুব আমাকে ফোন করে দেখা করার জন্য বলে। তখন আমি তার বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করি। এসময় তিনি আমাকে বলেন, ‘তুমি যে কাজ করেছো তা থেকে বাঁচতে এ সপ্তাহের মধ্যে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে, নইলে তোমাকে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে দেবো।’ আমি ভয় পেয়ে বাড়িতে চলে আসি। পরে অতি কষ্টে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সপ্তাহের শেষ দিনে আমার শ্বশুরসহ এএসপির বাসায় যাই। সেখানে আমার শ্বশুরসহ আমি তার হাত-পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে অনেক কাকুতি-মিনতি করি। কিন্তু মোহাম্মদ আয়ুব বাকি ৪০ হাজার টাকা না দিলে মামলায় জড়ানোর বিষয়ে পরিষ্কাভাবে বলে দেন। আমরা অসহায় হয়ে ১০ হাজার টাকা দিয়ে তার বাসা থেকে চলে আসি।”
আমার স্ত্রী আমাকে খোঁজার কারণ জিজ্ঞাসা করলে মোহাম্মদ আয়ুব গালি দিয়ে বলেন, ‘মাগি তোর স্বামীকে ধরতে আমার কোনো কেইস লাগবে নাকি? জানিস আমি চার থানার এএসপি সার্কেল? তোর স্বামী কোথায় বল?’ তখন আমার স্ত্রী আয়ুবকে ভদ্র ভাষায় কথা বলতে বললে সে ক্ষিপ্ত হয়ে আমার স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে লাত্থি মেরে ফেলে দেয়।
আ. কুদ্দুস আরও বলেন, “বাকি ৪০ হাজার টাকা না দেয়ায় ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি আনুমানিক রাত ১টার সময় কোনো মামলা বা ওয়ারেন্ট ছাড়াই এএসপি মোহাম্মদ আয়ুব আমার বাড়িতে হানা দেয়। সেদিন আমি আমার শ্বশুর বাড়িতে থাকায় আমার স্ত্রী এক ভাতিজিকে নিয়ে ঘুমিয়েছিল। সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘরে ঢুকে ঘরের বিভিন্ন জায়গা তল্লাশি করতে থাকে এবং আমার খোঁজ করে। আমার স্ত্রী আমাকে খোঁজার কারণ জিজ্ঞাসা করলে মোহাম্মদ আয়ুব গালি দিয়ে বলেন, ‘মাগি তোর স্বামীকে ধরতে আমার কোনো কেইস লাগবে নাকি? জানিস আমি চার থানার এএসপি সার্কেল? তোর স্বামী কোথায় বল?’ তখন আমার স্ত্রী আয়ুবকে ভদ্র ভাষায় কথা বলতে বললে সে ক্ষিপ্ত হয়ে আমার স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে লাত্থি মেরে ফেলে দেয়। আর বলে, ‘তোর স্বামীকে কাল দিনের মধ্যে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে আসতে বলবি। না হলে পুলিশ কি জিনিস বুঝতে পারবি।’ এরপর বাড়ির সব ঘর তল্লাশির নামে তছনছ করে। আমার বৃদ্ধা মা সামনে আসলে তার সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেন মোহাম্মদ আয়ুব।”
“পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ৭ মে তারিখে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কে রিকশা-ভ্যান শ্রমিকদের সঙ্গে এএসপি মোহাম্মদ আয়ুবের গণ্ডগোল হয়। সে সময় তিনি বিভিন্ন থানা থেকে ফোর্স এনে ১৭ জনকে আটক করেন এবং দ্রুত বিচার আইনে সলঙ্গা থানায় ২৭ জনের নামে মামলা করেন। আমি সেদিন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন সাহেবের স্ত্রীর চিকিৎসাজনিত কারণে ঢাকায় অবস্থান করছিলাম। কিন্তু ঘুষের ওই ৪০ হাজার টাকা না দেয়ার কারণে এএসপি প্রতিহিংসা বশত আমাকে সেই মামলার ২৭ নাম্বার আসামি করেন এবং আমাকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদান করতে থাকেন। বলেন, ‘শালা আদালতে হাজির হলেই রিমান্ডে এনে ক্রস ফায়ার করবো।’ এরপর ২০০৭ সালের ৪ জুন আমি স্বরাষ্ট্র সচিব এবং পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর ন্যায় বিচার চেয়ে আবেদন করি। তার সূত্র ধরে রাজশাহী বিভাগের এডিশনাল ডিআইজি মহোদয় রায়গঞ্জ থানায় বসে ঘটনার তদন্ত করেন। পরে ওই মামলা থেকে আদালত আমাকে নির্দোষ খালাস দেন। কিন্তু তারপরও মোহাম্মদ আয়ুব প্রতিনিয়ত আমাকে হুমকি অব্যাহত রেখেছেন। তিনি বলেছেন আমাকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে জেলের ঘানি টানাবেন, ক্রস ফায়ার করবেন, আমাকে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দেবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি। যে কারণে আমি নিজের বাড়িতে থাকতে নিরাপদ বোধ করছি না।”
আবেদনে এই জুলুমবাজ কর্মকর্তার রোষানল থেকে মুক্ত করার অনুরোধ করেন আ. কুদ্দুস। তিনি বলেন, ঐ সার্কেল এএসপির ভয়ে আমি কতদিন পালিয়ে বেড়াবো?
রায়গঞ্জ এএসপি ক্ষমতার অপব্যবহারকারী মোহাম্মদ আয়ুবের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। তিনি দম্ভ করেন শত অন্যায় করলেও কেউ তার কিছু করতে পারবে না। কেননা তিনি বিপুল ক্ষমতাধর এক সরকারি কর্মকর্তার শ্যালক। তার দাবিকৃত ঘুষের টাকা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় এক বছর ধরে ৫০ জন নিরপরাধী ব্যক্তিকে জেল হাজত খাটিয়েছেন তিনি।
হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সাবেক ট্রাস্টি চিত্তরঞ্জন কর পুলিশ সুপার, সিরাজগঞ্জ বরাবর এক অভিযোগে সার্কেল এএসপি মোহাম্মদ আয়ুবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানান। অভিযোগে তিনি বলেন, ‘রায়গঞ্জ এএসপি ক্ষমতার অপব্যবহারকারী মোহাম্মদ আয়ুবের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। তিনি দম্ভ করেন শত অন্যায় করলেও কেউ তার কিছু করতে পারবে না। কেননা তিনি বিপুল ক্ষমতাধর এক সরকারি কর্মকর্তার শ্যালক। তার দাবিকৃত ঘুষের টাকা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় এক বছর ধরে ৫০ জন নিরপরাধী ব্যক্তিকে জেল হাজত খাটিয়েছেন তিনি। হয়রানির শিকার হয়েছেন আরও ২ শতাধিক নির্বিবাদী মানুষ। ভুক্তভোগীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ হেড কোয়ার্টারসহ বিভিন্ন জায়গায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।’
অভিযোগে তিনি আরও বলেন, ‘তাড়াশ থানার মাদারজানি গ্রামের কৃষক আমজাদ হত্যা মামলার প্রকৃত আসামিকে আড়াল করতে মোটা অংকের ঘুষ নেন মোহাম্মদ আয়ুব। পরবর্তীতে তার নির্দেশে তাড়াশ থানার এস আই মশিউর রহমান হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ সাক্ষী ওই বাড়ির রাখালকে ধরে এনে মারপিট করে আসামি হিসেবে চালান দেয়। অসহায় রাখালের মা এসআই মশিউরসহ কয়েকজনের নামে মামলা করলে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।’
চিত্তরঞ্জন কর উল্লেখ করেন, ‘পুলিশ রক্ষকের ভূমিকায় না থেকে সার্কেল এএসপি মোহাম্মদ আয়ুবের নির্দেশে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এরপরও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভূক্তভোগী এলাকাবাসী স্তম্ভিত। এমন একজন ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা অনভিপ্রেত এবং অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’
এ ছাড়াও সে সময় সার্কেল এএসপি মোহাম্মদ আয়ুবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ পরিমাণ সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসব অভিযোগ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের কপি সিটি নিউজ ঢাকার কাছে সংরক্ষিত আছে।
এটা শাস্তিমূলক বদলি কীনা আমি জানি না। আমি সরকারি চাকরি করি। তাই যেখানে বদলি করা হবে, আমি সেখানে যেতে বাধ্য।
এসব বিষয়ে কথা বলতে মুঠোফোনে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আয়ুবের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিটি নিউজ ঢাকা। ৬ এপিবিএনে বদলি বিষয়ে তিনি বলেন, `এটা শাস্তিমূলক বদলি কীনা আমি জানি না। আমি সরকারি চাকরি করি। তাই যেখানে বদলি করা হবে, আমি সেখানে যেতে বাধ্য।`
তবে সিরাজগঞ্জে সার্কেল এএসপি থাককালীন সময়ের অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এড়িয়ে যান তিনি।