প্রকাশিত: জুলাই ৭, ২০২২, ০৯:০০ পিএম
মাধ্যমিক ও
উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের
নাটের গুরু মাউশিরই শিক্ষা কর্মকর্তা মাধ্যমিক-১ চন্দ্র শেখর হালদার ওরফে মিল্টন।
অভিযোগ রয়েছে, লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার আগেই
প্রশ্নপত্রের উত্তর হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীদের কাছে পৌঁছে দেন তিনি।
চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহের কাজ করান মাউশিরই কর্মচারীদের দিয়ে।
সম্প্রতি ঢাকা
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মিল্টনের প্রশ্নপত্র ফাঁস
করার তথ্য। গ্রেফতার হয়েছে মাউশির দুই কর্মচারী। তবে অজ্ঞাত কারণে মিল্টনকে এখনও গ্রেফতার করেনি ডিবি। মিল্টন প্রকাশ্যে অফিস করলেও ডিবির প্রতিবেদনে পলাতক দেখানো
হয়েছে।
ডিবি
প্রশ্নপত্র ফাঁসে মিল্টনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন শিক্ষাসচিব ও মাউশির
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দিলেও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া
হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে,
ছাত্রলীগের
কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক নেতা হওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না
কেউ। বিভিন্ন মহল থেকে প্রভাব খাটাচ্ছেন তিনি।
সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর ডিবি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
সেই প্রতিবেদনের
তথ্য অনুযায়ী, প্রশ্নফাঁসের হোতা মাউশির শিক্ষা কর্মকর্তা
মাধ্যমিক-১ চন্দ্র শেখর হালদার মিল্টন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক
সহ-সভাপতি ও ৩১ বিসিএসের (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) এই কর্মকর্তাকে পুলিশের
প্রতিবেদনে পলাতক দেখানো হয়েছে।
মাউশির অফিস
সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ছিল
সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এ ঘটনায় অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে
আসার মতো হয়েছে। যে কারণে তদন্তের গতি থমকে গেছে। মামলাটি তদন্ত করছে ডিবির
তেজগাঁও বিভাগ।
গত ১৩ মে রাজধানীর
৬১টি কেন্দ্রে মাউশির অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক (গ্রেড-১৬) পদের
নিয়োগ পরীক্ষা হয়। ৫১৩টি পদের জন্য প্রথম ধাপের নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় (এমসিকিউ)
অংশ নেন ১ লাখ ৮৩ হাজার চাকরিপ্রার্থী। পরীক্ষা চলাকালে ইডেন মহিলা কলেজ কেন্দ্রে
প্রশ্নের উত্তর প্রবেশপত্রে লেখা থাকায় সুমন জমাদ্দার (৩০) নামের একজনকে গ্রেফতার
করে ডিবি। এরপরই বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সুমনের দেয়া তথ্য ও প্রযুক্তির
সহায়তায় প্রশ্নফাঁসের দায়ে ডিবি একে একে গ্রেফতার করে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া বালিকা
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিতের সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম, বিসিএস শিক্ষা
ক্যাডারের ৩৪তম ব্যাচের পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রভাষক রাশেদুল ইসলাম (৩৪),
মাউশির
উচ্চমান সহকারী আহসান হাবীব (৪৫) ও মাউশির অফিস সহকারী মো. নওশাদুল ইসলামকে (৩৭)।
সংশ্লিষ্ট
সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর প্রশ্নফাঁসের
সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করে ডিবি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে গত ১৮ মে ডিএমপি কমিশনারকে
পাঠায়। একই দিন ডিবির সঙ্গে শিক্ষা সচিবের বৈঠকে প্রশ্নফাঁসের ওই প্রতিবেদন
উপস্থাপন করা হয়।
ডিবির একজন
অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) স্বাক্ষরিত দুই পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনের একটি কপি এসেছে
এ সিটি নিউজ ঢাকার হাতে। সেখানে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে বিস্তারিত
বর্ণনা রয়েছে। প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ‘মাউশির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ও
উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের তথ্য’ শিরোনামে লেখা হয়েছে, ‘পলাতক আসামি
চন্দ্র শেখর হালদার মিল্টন, যিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে
(মাউশি) শিক্ষা কর্মকর্তা মাধ্যমিক-১ হিসেবে কর্মরত। তিনি ওই পরীক্ষার প্রশ্নের
উত্তর গ্রেফতারকৃত আসামি সাইফুল ইসলামের কাছে পাঠান মর্মে সাইফুল ইসলাম জানায়।
সাইফুল ইসলাম হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে উত্তর পাঠায় গ্রেফতারকৃত আসামি রাশেদুল ইসলাম
রাজু ও মো. সুমন জমাদ্দারের নিকট।’
এ ছাড়া
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গ্রেফতার আসামি মো. আহসানুল হাবিব
(উচ্চমান সহকারী, মাউশি) ও মো. নওশাদুল ইসলামের (অফিস সহকারী কাম
কম্পিউটার অপারেটর, মাউশি) সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। পলাতক
আসামি মো. মকবুল হোসেন (ক্যাশিয়ার বদরুন্নেসা কলেজ) এবং আব্দুল মালেকসহ (সরকারি
তিতুমীর কলেজের বুক সেন্টার) অজ্ঞাতনামা অনেকের ওই পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র
ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।’
মিল্টনকে
গ্রেফতার করতে পারলে প্রশ্নফাঁস সিন্ডিকেটের আরো অনেককেই পাওয়া যেত বলে মনে করছেন
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পুলিশ তাকে পলাতক বললেও তিনি অফিস করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া
গেছে।
অভিযোগ রয়েছে,
চাকরির
নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনা তদন্তে যখনই প্রভাবশালী হোতাদের সংশ্লিষ্টতা পায়
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তখনি তদন্ত কার্যক্রম থমকে যায়।
বিভিন্ন সময় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় চুনোপুঁটিদের আইনের আওতায় আনলেও রাঘব-বোয়ালরা
থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রভাবশালী মহল থেকে তদবির ও প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে
যাচ্ছেন প্রশ্নফাঁসের এসব হোতা। জড়িতদের মধ্যে যারা ধরা পড়েন, তাদের
বেশিরভাগই জামিনে ছাড়া পেয়ে যান।
সংশ্লিষ্ট
সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায়
গ্রেফতারকৃতদের আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে অনেক প্রভাবশালীর নাম আসে।
কিন্তু তদন্তের স্বার্থে তাদের জিজ্ঞাসাবাদেরও সুযোগ পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট
কর্মকর্তারা। এতে অসম্পূর্ণ থাকে তদন্ত প্রক্রিয়া, আদালতে তদন্ত
প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ পিছিয়ে যায়। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে। যেসব ঘটনার
প্রতিবেদন জমা পড়ে, সেগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তদন্তে দুর্বলতা,
সাক্ষীকে
হাজির করতে না পারাসহ বিভিন্ন ত্রুটির কারণে খালাস পেয়ে যায় গ্রেফতারকৃতরা। এ নিয়ে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও হতাশ।
আদালত সূত্রে
জানা গেছে, গত ১৩ বছরে (২০০৯-২০২১) ডিএমপির বিভিন্ন থানায়
পাবলিক পরীক্ষা ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০০টি
মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগই প্রমাণ করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। এরই মধ্যে
নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫টি মামলা। এর মধ্যে মাত্র একটিতে এক আসামির মাত্র পাঁচ হাজার
টাকা অর্থদণ্ড হয়েছে।
প্রশ্নপত্র
ফাঁসে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে চন্দ্র শেখর হালদার ওরফে মিল্টন বলেন,
‘এই
বিষয়ে আমার কিছু জানা নাই। এসব বিষয়ে আমার কথা বলা নিষেধ আছে। আমি এ বিষয়ে আর কোনো
অ্যানসার দিতে পারবো না।’
জানতে চাইলে
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ
আক্তার বলেন, ‘আমাদের তদন্তে চন্দ্র শেখর হালদারের নাম এসেছে।
তবে আমরা এখনো চার্জশিট দেইনি, এখনও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে যদি তার
সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় অবশ্যই তাকে গ্রেফতার করা হবে।’
জেইউ/এএল