প্রকাশিত: জুলাই ৭, ২০২২, ০৭:৩৪ পিএম
দেশের প্রাইভেট
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি অন্যতম। শুধু তাই নয়,
এটি
দেশের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু করা এই
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা যায়। তবে এখানকার
ট্রাস্টিদের নানা অনিয়ম আর দুর্নীতিতে মুখ থুবরে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এই
অনিয়মকারীদের মধ্যে মূল হোতা ট্রাস্টি বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্য এম এ কাসেম। মূলত
তার অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতির কারণে ডুবেছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।
শুধু তিনি একাই
নন, এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তার পরিবারের একাধিক সদস্য। এই
সদস্যদের যে কোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হতে পারে। এ সংক্রান্ত আরও অনেক
চাঞ্চল্যকর তথ্য রয়েছে সিটি নিউজ ঢাকার কাছে।
জানা যায়,
নর্থ
সাউথ ইউনিভার্সিটি যে ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত তার ডিডে বলা আছে, মানবহিতৈষী,
দানশীল,
জনহিতকর,
অরাজনৈতিক,
অলাভজনক
ও অবাণিজ্যিকভাবে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হবে। অর্থের জোগান দেবে ট্রাস্ট। কিন্তু
এম এ কাশেম তার অনুগত ট্রাস্টিদের সঙ্গে নিয়ে নানা অনিয়মের মাধ্যমে এটিকে
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
তার দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে- শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, এফডিআর করার নামে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট, স্ত্রী-স্বজনদের চাকরি দেওয়ার নামে অনৈতিকভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে গাড়ি ক্রয় ও অবৈধভাবে বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহার এবং বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের আড়ালে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাত করা। এ সংক্রান্ত অভিযোগ দুদক তাকে তলব করলেও নানা অজুহাতে হাজির হননি তিনি।
এ ছাড়া অভিযুক্ত
ট্রাস্টিদের বিভিন্ন অনিয়মসংক্রান্ত তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি
কমিশন (ইউজিসি)। সিটিং এলাউন্স দুর্নীতি, জমি ক্রয়
দুর্নীতি, অতিরিক্ত ছাত্রভর্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের
টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি, অনুমোদনহীন বিভাগ পরিচালনাসহ অন্যান্য
বিষয় নিয়ে করা মোট ২৩টি অভিযোগের জবাব দিতে বলা হলেও অভিযুক্তরা কোনো জবাবই দেননি
বলে ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে।
অভিযুক্ত
ট্রাস্টিদের মধ্যে রয়েছেন- এমএ কাসেম, আজিম উদ্দিন, মোহাম্মদ
শাহজাহান, বেনজীর আহমেদ, আজিজ আল কায়সার
টিটো ও রেহানা রহমান। তারা সবাই কাসেম-আজিম সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য।
ইতোমধ্যে
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়
দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করার অভিযোগে এম এ কাশেমসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ৫ মে
মামলা করে দুদক।
এজাহারে বলা হয়,
নর্থ
সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং
শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের অনুমোদন/সম্মতির
মাধ্যমে ক্যাম্পাস উন্নয়নের নামে ৯০৯৬ দশমিক ৮৮ ডেসিমেল জমির দাম ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ
১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা বেশি দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
আসামিদের
বিরুদ্ধে অভিযোগ, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের হীন
উদ্দেশে কম দামে জমি কেনা সত্ত্বেও বেশি দাম দেখিয়ে তারা প্রথমে বিক্রেতার নামে
টাকা প্রদান করেন। পরবর্তীতে বিক্রেতার নিকট থেকে নিজেদের লোকের নামে নগদ চেকের
মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে আবার নিজেদের নামে এফডিআর করে রাখেন এবং পরবর্তীতে
নিজেরা উক্ত এফডিআরের অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
এই মামলায় আগাম জামিন নিতে গেলে কাশেমসহ চার ট্রাস্টিকে কারাগারে পাঠান আদালত।
অনুসন্ধানে জানা
গেছে, গত কয়েক বছর কাশেম-আজিম সিন্ডিকেটই ঘুরেফিরে ট্রাস্টি বোর্ডের
নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বোর্ডের কোনো সদস্য প্রতিবাদ করলেই
তাকে কৌশলে কোণঠাসা করে দেয়া হয়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির দখল নিয়ে আছে এই
সিন্ডিকেট। তাদের কারণে নর্থ সাউথে অনিয়মই পরিণত হয়েছে নিয়মে।
ছাত্রদের টিউশন
ফি থেকে অবৈধভাবে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি ক্রয়, এক
লাখ টাকা করে সিটিং অ্যালাউন্স, অনলাইনে মিটিং করেও সমপরিমাণ
অ্যালাউন্স গ্রহণ, নিয়ম ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডের ৪০৮ কোটি টাকা
নিজেদের মালিকানাধীন ব্যাংকে এফডিআর, মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে
কয়েকগুণ শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম ও জঙ্গি মদদ
বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন দফতরে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। পারস্পরিক যোগসাজশে আশালয়
হাউজিংয়ের কাছ থেকে জমি ক্রয়ের নাম করে লোপাট করেছেন ৪২৫ কোটি টাকা।
ব্লগার রাজীব
হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি নাফিস ইমতিয়াজকে ভর্তি করার প্রক্রিয়া শুরু হলেও
গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তারা সেখান থেকে সরে আসেন। আজিম-কাসেম সিন্ডিকেটের
বিরুদ্ধে জঙ্গি মদদ, পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে।
বিষয়গুলো দুদকের নজরে আনার পর সেগুলো নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।
জানা গেছে, তিন কোটি টাকায় গাড়ি কেনার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন ট্রাস্টি এম এ কাশেম। তিনি এ পর্যন্ত চারবার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান চেয়ারম্যান আজিম উদ্দীন এর আগে তিনবার চেয়ারম্যান ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
টাকায় গাড়ি কেনার বিষয়ে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘ইউজিসির
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে স্পষ্ট বলা আছে- বিশ্ববিদ্যালয় যত আয় করবে তা দিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালিয়ে যা অতিরিক্ত থাকবে, সেটা দিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য উন্নয়ন কাজ করা হবে। এখানে গাড়ি কেনার বিষয়টি
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা যে
কমিটমেন্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করেছেন, তার সঙ্গে এটা
কোনোভাবেই যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি কেনা অবশ্যই অনিয়ম। এটা
আর্থিক স্বেচ্ছাচারিতা।’
বোর্ড অফ
ট্রাস্টির সদস্যরা সিটিং অ্যালাউন্স হিসেবে কখনো কখনো এক লাখ টাকা নিয়েছেন,
কখনও কখনও ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এটা ইউজিসির প্রতিবেদনের তথ্য। ট্রাস্টি বোর্ডের
সদস্যরা এটা করতে পারেন কি না? এমন প্রশ্নে ড. আলমগীর বলেন, ‘সিটিং
অ্যালাউন্স নেয়ার যে সংস্কৃতি, সেটা অন্য কোথাও আছে কি না আমার জানা
নেই। তবে বাংলাদেশে এটা ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে। ট্রাস্টি বোর্ড মিটিংয়ে সিটিং
অ্যালাউন্স নেয়াটা যুক্তিযুক্ত না। ইউজিসির নির্দেশনায় বলা আছে, কিছু
ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত সিটিং অ্যালাউন্স নিতে পারে, এর
বেশি না।’
এক প্রোগ্রামের
কথা বলে দশটা প্রোগ্রাম চালাচ্ছে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। এমন সুযোগ আছে কি না,
জানতে
চাইলে ইউজিসির এই সদস্য বলেন, ‘এটা তারা কোনোভাবেই করতে পারে না। একটা
ডিপার্টমেন্টের অধীনে আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম একটাই থাকতে পারবে। তারা যেটা
করছে, সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ। শুধু তা-ই না, এসব প্রোগ্রামের
অধীনে যেসব শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট নিচ্ছে, সেগুলোরও কোনো
বৈধতা নেই ‘
তিনি আরো বলেন,
‘এভাবে
শিক্ষার্থীদের ব্ল্যাইমেইল করা হচ্ছে। এটা যেকোনো ধরনের গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে
পড়ে। কারণ কোনো শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে খেলার অধিকার নেই বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষের। তারা এটা জেনেশুনে করেছে। এখন ভাব দেখাচ্ছে যে তারা এটা জানে না। এখন
অনুমতির জন্য বলছে। এটা হয় নাকি?’
জেইউ/এএল