• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১

এবি ব্যাংকের দুই কর্মকর্তার রোষানলে দিশেহারা এরশাদ গ্রুপ!

প্রকাশিত: জুন ৯, ২০২২, ০৯:০৮ পিএম

এবি ব্যাংকের দুই কর্মকর্তার রোষানলে দিশেহারা এরশাদ গ্রুপ!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

(ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১ম পর্ব)

আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি আব্দুর রহমানের রোষানলে দিশেহারা হয়ে পরেছে দেশের অন্যতম শিল্প প্রতিষ্ঠান এরশাদ গ্রুপ। ফলশ্রুতিতে এই গ্রুপটি এখন ঋণ খেলাপি হয়ে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একই ঘটনায় প্রায় ১৩৪ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পরেছে এবি ব্যাংক। এছাড়াও মামলা-পাল্টা মামলায় জর্জরিত হয়ে পরেছে ওই ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও এরশাদ গ্রুপ। এবি ব্যাংক ডিএমডির (দায়িত্ব পালনকালে) অনৈতিক চাহিদা না মেটানোই এই রোষানলের কারণ বলে জানানো হয়েছে একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে।

গত বছরের ৪ মার্চ ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি অভিযোগ দায়ের করেন এরশাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এরশাদ আলী। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন- এবি ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তার ইচ্ছাকৃত অবহেলা এবং উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে এরশাদ গ্রুপ সম্মানহানীর স্বীকার হয়েছে। এছাড়া তার নামে দুদকের মামলা এবং সেই মামলার সূত্র ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশিত হয়। তিনি ওই সকল সংবাদের প্রতিবাদ জানান। একইসঙ্গে প্রকাশিত সংবাদে তার ও তার প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে মর্মে আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন।

এই অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য রমনা মডেল থানার ওসিকে নির্দেশ দেন বিজ্ঞ আদালত। পরবর্তিতে তদন্ত শেষে আদালতে গত ৯ এপ্রিল প্রতিবেদন জমা দেন রমনা মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. নূর মোহাম্মদ। সেই প্রতিবেদনে ব্যাংকের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার রোষানলে পরে দেশের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প গ্রুপ কিভাবে পথে বসতে চলেছে তার বিশদ বিবরণ উঠে এসেছে।

মামলার প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, লেনদেনের সূত্র ধরে মামলার স্বাক্ষী মো. আমিনুল ইসলামের মাধ্যমে ২০১৪ সালে সিটি ব্যাংকের তৎকালীন ডিএমডি আব্দুর রহমানের (৫০) সঙ্গে এরশাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান এরশাদ আলীর সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ অবস্থায় আব্দুর রহমান এরশাদ আলীর কাছে মোটা অংকের টাকা ধার চান। বিনিময়ে এরশাদ আলীকে ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দেন আব্দুর রহমান। এরশাদ আলী প্রথম পর্যায়ে রাজি না হলেও আব্দুর রহমানের অনুনয়-বিনয়ের কারণে তিনটি চেকের মাধ্যমে ত্রিশ লাখ টাকা ধার দেন। পরে আব্দুর রহমান আরো টাকা চাইলে এরশাদ আলীর সন্দেহ হয়। এসময় তিনি পূর্বে ধার দেয়া টাকা ফেরত চান। তখন আব্দুর রহমান তার গুলশানের ১২৭ নম্বর রোডের একটি ফ্ল্যাট এরশাদ আলীর কাছে বিক্রির প্রস্তাব দেন। পরে ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সাড়ে তিন কোটি টাকার বিনিময়ে সাব কবলা দলিল মুলে আব্দুর রহমানের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি কিনে নেন এরশাদ আলী। ওই বছরই ফ্ল্যাটটি বুঝে নিতে চাইলে আব্দুর রহমান কিছুদিন সময় চান এবং প্রতি মাসে ফ্ল্যাটের ভাড়া দেবেন বলে মৌখিকভাবে অঙ্গীকার করেন। এরশাদ আলী ফ্ল্যাটটি বুঝে না পাওয়ায় ওই বছরই আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রথমে সিআর মামলা করেন এবং পরে দেওয়ানী মামলা দায়ের করেন। মামলাটি চলাকালীন ২০১৮ সালে আব্দুর রহমান সিটি ব্যাংক থেকে এবি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় গুলশানে ডিএমডি পদে যোগদান করেন। এবি ব্যাংকেও এরশাদ আলীর লেনদেন ছিল। এবি ব্যাংকে যোগদানের কিছুদিন পরেই আব্দুর রহমান এরশাদ আলীকে ডেকে তার গুলশানের বিক্রি করা ফ্ল্যাটটি ফেরত চান এবং টাকা পরে পরিশোধ করবেন বলে জানান। এরশাদ আলী ওই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে তার ফ্ল্যাটটি বুঝিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। এতে আব্দুর রহমান ক্ষিপ্ত হন এবং তিনি এবি ব্যাংকের সঙ্গে কীভাবে লেনদেন করেন তা দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে এরশাদ আলী তার ক্রয়কৃত নারায়নগঞ্জের ‘জংদা রি রোলিংস মিলস লি.’ নামক রডের মিলটি এবি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক শাখা কাকরাইল এর মর্টগেজ অব চার্জ ক্রিয়েটেট এর বিপরীতে ২০ কোটি টাকা লোনের আবেদন করেন। ব্যাংকটির তৎকালীন শাখা ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার এরশাদ আলীর কাছ থেকে দাবিকৃত ২০ কোটি টাকা লোনের বিপরীতে লোন প্রদানের শর্তে ২০টি চেক (১৫টি ফাঁকা ও ৫ টি টাকার অংক বসানো) জামানত হিসেবে গ্রহণ করেন।  তারপর লোন দিতে কালক্ষেপন করতে থাকেন। এরমধ্যে এরশাদ আলীর ব্যবসায়ীক মন্দার কারণে এবি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক কাকরাইল শাখার পূর্বের টাকার লোন অনিয়মিত হয়ে পরে। এর প্রেক্ষিতে জংদা রি রোলিংস মিলস লি. অকেজো হয়ে পরে। এতে এরশাদ আলী ঋণ খেলাপির অন্তর্ভুক্ত হন। যে কারণে পরবর্তিতে এরশাদ আলী ও তার প্রতিষ্ঠান একাধিক মামলা মোকাদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে বাদী ও এবি ব্যাংকের তৎকালীন ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয় এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়াতে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়। 

প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিআরপিডি সার্কুলার, তারিখ ১৬ই মে ২০১৯ মূলে ঋণ খেলাপিদের লোন পূনঃতফসিল করার জন্য দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে রিসিডিউল করার সুযোগ প্রদান করেন। এরশাদ আলী ১৩৪ কোটি ৪০ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭ টাকা লোনের দুই শতাংশ হারে দুই কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার ৫৪২ টাকা জমা দেয়ার জন্য বিআরপিডি সার্কুলার মুলে এবি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক কাকরাইল শাখার ব্যবস্থাপক ফরিদ আহম্মেদ ফকিরের নিকট রিসিডিউলের আবেদন করেন। পরে ফরিদ আহম্মেদ ফকিরের পরামর্শে এরশাদ আলী ইসলামী ব্যাংক কাকরাইল শাখায় ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ২০ লাখ টাকা রিসিডিউলের জন্য জমা দেন। পূনরায় ৮০ লাখ টাকার পে-অর্ডার এবং অবশিষ্ট  এক কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার ৫৪২ টাকার চেক প্রদান করতে গেলে শাখা ব্যবস্থাপক ফরিদ আহম্মেদ ফকির তা গ্রহণ না করে এরশাদ আলীকে ব্যাংকের ডিএমডি আব্দুর রহমানের সঙ্গে পূর্বের ফ্ল্যাট সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসা করতে বলেন।

পরে রিসিডিউলের জন্য প্রদানকৃত ২০ লাখ টাকা ভিন্নখাতে খরচ দেখিয়ে শাখা ব্যবস্থাপক ফরিদ আহম্মেদ ফকির এরশাদ আলীকে চিঠি প্রদান করেন এবং এরশাদ আলীর বিরুদ্ধে জামানত চেক দ্বারা আদালতে ৫টি মামলা দায়ের করেন। পরে এরশাদ আলীও তার প্রদানকৃত চেক ভিন্নভাবে ব্যবহার করায় ফরিদ আহম্মেদ ফকির ও আব্দুর রহমানকে প্রথম লিগ্যাল নোটিশ এবং পরে সিআর মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে বাদী এবং বিবাদীদের মধ্যে বিজ্ঞ আদালতে এবং বিভিন্ন সংস্থায় একাধিক মামলা ও পাল্টা মামলা হয়, যা এখনো চলমান আছে।

প্রতিবেদনের শেষে উল্লেখ করা হয়েছে, ফ্ল্যাট সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ আব্দুর রহমান কর্তৃক এরশাদ আলীর সঙ্গে সমাধান না করা, শাখা ব্যবস্থাপক ফরিদ আহম্মেদ ফকির কর্তৃক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেও লোন রিসিডিউল না করায় বাদীর পূর্বের লোন অনিয়মিত হয়ে পরে। পরবর্তীতে বাদী এরশাদ আলীর বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয় এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে দুদকের মামলা সংক্রান্ত বিষয় প্রকাশিত হয়। বাদীও প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানায়। বিবাদী আব্দুর রহমান এবং ফরিদ আহম্মেদ ফকিরের এমন কর্মকাণ্ডে ফলে বাদী এরশাদ আলী ও তার প্রতিষ্ঠানটি সম্মানহানীর পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির স্বীকার হয় বলে প্রতিয়মান হয়। এছাড়া এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ. (রুমী) আলী (৫৫) এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিক আফজালের বিরুদ্ধে বাদী এরশাদ আলী কর্তৃক আনিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় নাই।     

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে এবি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত প্রায় একমাস আগে ডিএমডি আব্দুর রহমানকে চাকরিচ্যুত করে। একই অভিযোগ এবি ব্যাংকের কাকরাইল শাখার ব্যবস্থাপক ফরিদ আহম্মেদ ফকিরকে শাখা থেকে ক্লোজ করে প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসে।

এছাড়াও পুলিশের দেয়া প্রতিবেদনে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সেসব বিষয়ে জানার জন্য তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু তিনি এসব বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো মামলাধীন বিষয় তো, এগুলো তো ফোনে কথা বলবো না।’ পুলিশের দাখিল করা প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা কোনো প্রতিবেদন না’।  এসময় ব্যস্ততার কথা বলে পরে ফোন করতে চান তিনি। পরবর্তিতে তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। 

এবি ব্যাংক কাকরাইলের শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক ফরিদ আহম্মেদ অভিযোগের বিষয়ে ফরিদ আহম্মেদ ফকির বলেন, ‘আমি অতি সম্প্রতি কিন্তু ওখান থেকে ট্রান্সফার’। অভিযোগ ইস্যুতে বদলি কী-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না না, এই ইস্যু কী-না... আমাকে ডিভিশনে বদলি করা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকিং ডিভিশনে’। এরপর তিনিও মুঠোফোনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করে প্রতিবেদককে তার দেখা করে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। প্রতিবেদক তার আমন্ত্রণ এড়িয়ে গেলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান।

(বিস্তারিত পরের পর্বে) 


আরআই 

আর্কাইভ