• ঢাকা শুক্রবার
    ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
টাকার মান কমেছে ৪৬ শতাংশ

অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এখন বড় চ্যালেঞ্জ, সংকটের স্থায়িত্ব আরও বাড়ছে

প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৪, ১১:৪৫ পিএম

অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এখন বড় চ্যালেঞ্জ, সংকটের স্থায়িত্ব আরও বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) চাপ মোকাবিলা করা। সংস্থাটির শর্ত অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির হার কমাতে আগামী অর্থবছরেও মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করতে হবে। এটি করলে সুদহার বাড়াতে ও টাকার প্রবাহ কমাতে হবে। 

ফলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, কর্মসংস্থানে দেখা দেবে স্থবিরতা। তখন ভোক্তার ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেড়ে যাবে। এই চাপ কমাতে হলে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এটি করতে সুদের হার কমাতে ও টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে। এতে মূল্যস্ফীতির হারে কিছুটা চাপ পড়লেও মানুষের আয় বাড়লে তা কিছুটা প্রশমন করা সম্ভব হবে। কিন্তু আইএমএফের শর্তের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই দিকে হাঁটতে পারছে না।   

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ ও  অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলাপ করে দেশের সার্বিক অর্থনীতির এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে চলমান সংকটের স্থায়িত্ব আরও বাড়ছে। ২০২২ সালের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ডলারের সংকট কেটে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। ডলার সংকট কিছুটা কমলেও পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও ডলার সংকট থাকবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে গিয়ে এ সংকট কেটে যাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ফলে আলোচ্য সময়ের মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার আরও অবমূল্যায়ন হবে। এতে একদিকে আমদানি ব্যয় ও বৈদেশিক দেনা বেড়ে যাবে। টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। তখন মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে।

এই চাপ মোকাবিলায় আইএমএফ বলেছে, টাকার আরও অবমূল্যায়ন করতে। তাহলে ডলার প্রবাহ বেড়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু গত ২ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ৪৬ থেকে ৫২ শতাংশ। এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতিতে যে চাপ পড়েছে সেটি এখনও চলমান রয়েছে। এর মধ্যে টাকার মান আরও কমালে চাপ আরও বেড়ে যেতে পারে। কারণ ডলারের দাম বাড়ানোর পরও এখন এর সরবরাহ বাড়ছে না। ফলে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের সুফল আসছে না অর্থনীতিতে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলন, আইএমএফের যেসব শর্ত জরুরিভিত্তিতে বাস্তবায়ন প্রয়োজন সেগুলো করা হচ্ছে না। ব্যাংক খাতের সংস্কার করা জরুরি। যত দ্রুত এটি করা হবে ততই মঙ্গল। কিন্তু এটি করা হচ্ছে না। যেসব শর্ত বাস্তবায়ন পর্যায়ক্রমে করা প্রয়োজন সেগুলো করা হচ্ছে দ্রুত। এতে অর্থনীতিতে অস্থিরতা আরও বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, সুদের হার বাড়ানো বা কমানোর একটি ছন্দ থাকতে হবে। সেটি নেই। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ানো হচ্ছে। এতে বেসরকারি খাত বিপাকে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ বাড়বে না, কর্মসংস্থান হবে না। ফলে চড়া মূল্যস্ফীতির আঘাতে মানুষ আরও বেশি জর্জরিত হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এতে টাকার প্রবাহ কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিল্পে ও উৎপাদন খাতে। চড়া মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে ২ বছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, টাকার প্রবাহ কমানো হয়েছে। বিনিয়োগ কমেছে। ভোক্তার চাহিদা কমেছে। তাতেও মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। উলটো বেড়ে যাচ্ছে। মে মাসে এই হার আরও বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি ওঠেছে। আইএএফের শর্ত অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে আরও কঠোর মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হবে। এতে সুদের হার আরও বাড়বে, ডলারের দাম বাড়বে। ফলে বিনিয়োগ কমে মন্দা আরও প্রলম্বিত হবে।

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা শুরু হয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত একদফা এর দাম কমেছে, বেড়েছে দুদফা। এর প্রভাবে পরিবহণ ভাড়া বেড়েছে। কিন্তু কমানোর পর তা কমেনি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রভাব ইতোমধ্যে ভোক্তা পর্যায়ে পড়তে শুরু করেছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে।

ডলার সংকট এখনও অর্থনৈতিক মন্দার প্রধান কারণ। ডলার সংকট কাটাতে হুন্ডি ও টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে আইএমএফের সরাসরি কোনো শর্ত নেই। সরকার থেকেও এ ব্যাপারে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেই। ফলে মুদ্রা পাচার যেমন চলছে, তেমনি রেমিট্যান্সের একটি অংশ আসছে হুন্ডিতে। ফলে বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ছে না। যেটুকু ডলার আসছে তা আবার পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। ফলে ডলারের দাম বাড়ানো হলেও সংকট কাটছে না। মাঝপথে ভোক্তার ভোগান্তি আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, হুন্ডি ও টাকা পাচার বন্ধ করলে ডলার সংকট অনেকটা কমে যায়। কিন্তু সরকার  এটি করছে না। ডলার সংকট নিরসনে যে পথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাঁটছে সেই পথে স্থায়ী কোনো সমাধান নেই। টাকার মান কমানোর ফলে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়েনি।

তিনি আরও বলেন, আইএমএফের কিছু শর্ত ভালো। এগুলো আমরাও অনেকবার বলেছি। কিন্তু সেগুলো করা হচ্ছে না। যেগুলো ধীরে ধীরে করার কথা, সেগুলো করছে দ্রুত। এতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেয়ে আরও বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। 

সূত্র জানায়, ২ বছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের ফলে অর্থনীতিতে কি প্রভাব পড়েছে তার একটি মূল্যায়ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে দেখা যায়, সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের ফলে টাকার প্রবাহ কমেছে, সুদের হার বেড়েছে। সরকারের ঋণের খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সরকারকে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো লাভ করছে। কিন্তু সরকার জনগণের করের টাকায় ওই ঋণের সুদ পরিশোধ করছে। এতে জনগণর ওপর চাপ বেড়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমেনি। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবার মুদ্রানীতি খুব বেশি সংকোচনমুখী করতে চাচ্ছে না। সুদের হার আর না বাড়িয়ে স্থিতিশীল রাখতে চায়। কারণ বিনিয়োগ বাড়িয়ে তারা কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরি করতে চায়। কিন্তু আইএমএফের শর্ত মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত মুদ্রানীতিকে আরও কঠোর করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, উৎপাদন খাতে টাকার জোগান আর কমানো যাবে না। অন্য খাতে কমিয়ে উৎপাদন খাতে টাকার জোগান বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তা না হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে না। এটি না বাড়লে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হবে।

আইএমএফ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকারের অনুক‚লে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ইতোমধ্যে দুটি কিস্তিতে ১১৬ কোটি ডলার পেয়েছে। তৃতীয় কিস্তি বাবদ আরও ১১৫ কোটি ডলার জুনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। ওই ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এখন অর্থনীতিতে চাপের সৃষ্টি হয়েছে।

ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড়ের পর ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আইএমএফ এক প্রতিবেদনে বলেছিল, এই ঋণের অর্থ বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিপত্রের ঘাটতি কমাবে। একই সঙ্গে বাজারে নিত্যপণ্যের দামের ওপর চাপ কমবে। বাস্তবে স্থিতিপত্রের চাপ কিছুটা কমাতে সহায়তা করেছে। কিন্তু তা বাজারের  ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। পণ্যের দাম কমেনি। বরং বেড়েই চলেছে।

আর্কাইভ