• ঢাকা সোমবার
    ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

ফলের বাজারেও সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২৩, ০৫:০৭ পিএম

ফলের বাজারেও সিন্ডিকেট

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

দেশে আমদানি করা ফলের প্রধান বাজার রাজধানীর বাদামতলী। অভ্যন্তরীণ এবং আমদানি করা ফলের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসাই ব্যস্ততম এই পাইকারি বাজারকেন্দ্রিক। প্রতিদিন প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার ফল বেচাকেনার এই বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। নিজেদের মন মতো ফলের দাম নির্ধারণ, ফলের কার্টনে ওজন কম দেওয়া, সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়সহ নানাভাবে ফায়দা লুটছেন তারা। দেশের বৃহৎ এই ফলের বাজারকে এভাবে অস্থিতিশীল করে রাখায় বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের খুচরা ফল বিক্রির দোকান ঘুরে দেখা গেছে, একই ফলের দাম স্থানভেদে ভিন্ন। এ ছাড়াও ফলের দোকানে গত বছরের তুলনায় এবার দাম কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি।

এদিকে জুন ২০২৩ থেকে সব ধরনের খেজুর আমদানিতে শুল্কায়ন মূল্য বৃদ্ধি করায় খেজুর আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে রোজার সময় খেজুর সংকট তৈরি হবে। দাম চলে যাবে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

রাজধানীর বাদামতলী ফলের

বাজারের কমপক্ষে ১৫ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় সিটি নিউজ ঢাকার। প্রত্যেকেই জানান, বাদামতলী ফলের বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। ফলের দাম ওঠানামার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। বর্তমানে ডলার সংকট এবং বৈশ্বিক সমস্যা দেখিয়ে এই সিন্ডিকেট ফলের দাম বাড়িয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে আমদানি করা মোট খেজুরের ৯৫ শতাংশের বেশি আসে ইরাক, দুবাই, তিউনেশিয়া ও আলজেরিয়া থেকে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর খেজুরের মৌসুম। খেজুর উৎপাদনকারী দেশগুলোতে এবারের মৌসুম প্রায় শেষের পথে। তবে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির কারণে এ বছর দেশের ছোট ব্যবসায়ীরা এখনো খেজুর কিনতে পারেননি। রমজানের কাছাকাছি সময়ে বর্ধিত শুল্ক কমানো হলেও তখন এলসি করতে হলে বেশি দামে কিনতে হবে। আবার সময় স্বল্পতার কারণে তখন খেজুর ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানো কঠিন হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ডলার সংকটের কারণে গত প্রায় ছয় মাস ধরে নিয়মিত ফল আমদানিকারকদের বেশিরভাগ এলসি খোলার সুযোগ পাননি। কিন্তু মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে বিদেশি ফল আমদানি করেছে। আমদানি করা এসব ফল মজুদ রেখে চাহিদার তুলনায় কম পরিমাণে বাজারে সরবরাহ করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক শামসুল ইসলাম, আফছার হাজি, রয়েল ফুডের মুরাদ, মনির হোসেন ও মদিনা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এ ফলের বাজার। ইতোমধ্যে খেজুর মজুদ করেছে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। বিভিন্ন দেশের নানা জাতের খেজুরে তাদের হিমাগারগুলো ভরপুর। শুল্কায়ন ও ডিউটি বৃদ্ধির কথা বলে এ চক্রটি অধিক মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে।

তবে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের দাবি, শুল্ক বৃদ্ধির কারণে খেজুর আমদানির জন্য এখনো এলসি খোলা হয়নি। সমিতির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠানো এক আবেদনপত্র থেকে জানা যায়, পিপি ব্যাগে খেজুর টনপ্রতি ৫০০ ডলার, কার্টনে ইরাক, দুবাই, আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়া থেকে ১ হাজার ডলার এবং মিশর ও সৌদি থেকে আগের তুলনায় ৩ হাজার ইউএস ডলার বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এ বর্ধিত শুল্ক প্রত্যাহার চান।

এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য-৫-এর যুগ্ম সচিব শামীমা আকতার স্বাক্ষরিত এক পত্রে আসন্ন পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে খেজুরের বর্ধিত আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়। তবে এনবিআর এ পত্র আমলে নিচ্ছে না বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।

এ বিষয়ে এনবিআরের শুল্ক নীতি-সংক্রান্ত সদস্য মো. মাসুদ সাদিক সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সুপারিশ পাওয়া গেছে। তবে শুল্ক কমানোর কোনো সুযোগ নেই। শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তটা সরকারের ওপর মহল থেকে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সুপারিশ করলেও তা কার্যকর করার এখতিয়ার এনবিআরের নেই।’

ফল ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য মতে, বাদামতলীতে প্রতিদিন প্রায় ১৮০ থেকে ২০০টি ট্রাক ও পিকআপ ভর্তি আমদানি করা ফল আসে। প্রতি ট্রাক ফল বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা।

বাদামতলী ঘুরে দেখা গেছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা ২০ কেজির ফলের প্যাকেট ভেঙে তিন কেজির প্যাকেট তৈরি করা হচ্ছে। মোটা কাগজের প্যাকেটে ফল রেখে ওপর-নিচে প্লাস্টিকের মোড়ক দেওয়া হচ্ছে। ফলে ২০ কেজি ফলের ওজন ২৪ কেজি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে খুচরা ব্যবসায়ী এবং ক্রেতারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় আপেল, আঙুর, কমলা, মাল্টা, ডালিম ও নাশপাতি। বিশ্বের ৪৬টি দেশ থেকে এই ছয়টি ফল আমদানি হয়। এর মধ্যে চীন, ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ভুটান, মিশর ও দক্ষিণ আফ্রিকা অন্যতম।

বিদেশি ফলের বাজারে বেশি আধিপত্য আপেল, মাল্টা ও আঙ্গুরের। আর রোজার মাসে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে খেজুরের। তাই এসব ফলের বাজারকে কেন্দ্র করেই বেশি সক্রিয় সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে খেজুরসহ বিদেশি ফলের দাম যতটা বাড়ার কথা, বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে। মৌসুমি আমদানিকারক, মধ্যস্বত্বভোগী এবং আড়তদাররা এসব দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে ভূমিকা রাখে। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি বছর দেশে ফল আমদানির পেছনে চলে যায় গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ আকালের দিনে বিদেশি মুদ্রা দেশের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে সরকার অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি সব ধরনের ফল আমদানিকেও নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। সম্প্রতি হরতাল অবরোধের ফলে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। হরতালের আগে চট্টগ্রাম থেকে যে কাভার্ড ভ্যান ভাড়া দিতে হতো ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এখন তাতে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।

রাজধানীর বাদামতলী ফলের বাজারের আমদানিকারকরা বলছেন, এনবিআর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানোর পরে বাজারে ফল আমদানি কমেছে অন্তত ৩০ শতাংশ। এতে ব্যবসা কমেছে। অন্যদিকে পণ্যের দাম বেড়েছে ১০-২০ শতাংশ। পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, মুনাফা কমিয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন তারা।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দীন আহমেদ বলেন, দেশে প্রতিদিন ফলের চাহিদা ১০ থেকে ১২ হাজার টন। সারা বছর ধরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ফল আমদানি হয়। সরকার এতে রাজস্ব পায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ফল আমদানি কমে যাওয়ায় সরকার বাড়তি শুল্ক আরোপ করে কম রাজস্ব পাবে। অন্যদিকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত ভোক্তাকে আরও বেশি দামে বিদেশি ফল খেতে হবে।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাথী ফ্রুটসের মালিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কোনো কারসাজির সঙ্গে জড়িত নই। সবাই প্রকৃত ফল ব্যবসায়ী। বিদেশি ফলকে ‘বিলাসপণ্য’ দেখিয়ে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় সব ফলের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। উচ্চহারে শুল্কায়ন মূল্য নির্ধারণ করায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।’

এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, ‘কাস্টমসে মালপত্র খালাস করতে ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাড়ছে পরিবহন খরচ। কোনো খরচই কমে না; কিন্তু ফলের দাম বাড়লে দোষ হয় আমাদের। খেজুরের শুল্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় কেউ এখনো খেজুর কিনেননি। এ কারণে রোজায় ফ্রেস খেজুর পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তাছাড়া সব ফলেরই দাম বাড়বে। তবে টাকা পাচার করে যারা অবৈধভাবে ফল আমদানি করছেন আমরা চাই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক সরকার।’

 

সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন

 

জেকেএস/

অর্থ ও বাণিজ্য সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ