• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০৭ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১
পেট্রোডলার

কোনটি বেশি সংকটে, জ্বালানি তেল নাকি ডলার?

প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২৩, ০৩:২৫ এএম

কোনটি বেশি সংকটে, জ্বালানি তেল নাকি ডলার?

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

বিশ্ববাজারে চলছে ‍‍`ডি-ডলারাইজেশন‍‍` এর প্রয়াস। পাশাপাশি জলবায়ু ইস্যুতে প্রশ্ন উঠছে জ্বালানি তেলের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে। যখন ডলার ও তেল দুটিই প্রশ্নবিদ্ধ তখন সবার আগ্রহ আগামীর পেট্রোডলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ডলারের বাজারে দেখা দিয়েছে মারাত্মক অস্থিরতা। দেশে দেশে মুদ্রার মান অবমূল্যায়ন ও ডলারকে সামরিক অস্ত্রের মতো ব্যবহারে অতিষ্ঠ বিশ্ববাসীর একাংশ খুঁজছে ডলারের বিকল্প। বিশেষ করে পশ্চিমারা বাদে বাকিদের ডলারের ওপর আস্থা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। নিজেদের আঞ্চলিক মুদ্রায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে তারা।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন সৌদি আরবকে তাদের সব পেট্রোলিয়াম পণ্য, অর্থাৎ শোধিত তেল, খনিজ তেল ও গ্যাস একমাত্র মার্কিন ডলারে বিক্রি করার প্রস্তাব দেন। যার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সৌদি আরবকে পূর্ণ সামরিক নিরাপত্তা প্রদান করবে এবং শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে। সে সময়ে প্রথমে সৌদি আরব এবং পরে অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশ চুক্তিটি স্বাক্ষর করে এবং এর মধ্যদিয়ে পেট্রোডলারের যাত্রা শুরু হয়।

পেট্রোডলারের রাজনীতিকে এক লাইনে ব্যাখ্যা করতে হলে বলতে হবে- ‍‍`ডলারের ওপরে বাধ্যতামূলক নির্ভরশীলতা তৈরি করা।‍‍` অর্থাৎ কোনো দেশ ডলার ছাড়া তেল কিনতে পারবে না, আর ডলার পেতে হলে দ্বারস্থ হতে হবে মার্কিনীদের।

এই চেইন মেনে চলার মাধ্যমে বিশ্বের প্রতিটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতের মুঠোয় থাকে। চাইলেই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়া যায়- যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইরান।

তেলের দাম ডলারে নির্ধারণ করার অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা হচ্ছে, তেলের মূল্য যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রানীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যখন দেশীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হয়ে যায়, তখন তেল আমদানিকারক দেশগুলোকে বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হয়। অপরদিকে রফতানিকারক দেশগুলো লাভবান হয়। আর যখন ডলারের মূল্যমান কমে যায়, তখন আমদানিকারক দেশগুলো লাভবান হয় এবং রফতানিকারক দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ কারণে তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো অর্থনৈতিক ঝুঁকি এড়াতে সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের মুদ্রানীতির সামঞ্জস্য রেখে চলে। শুধু মুদ্রানীতি নয়, তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের এতদিনের মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক শীতল এবং ডলারের বদলে চীনের সঙ্গে ইউয়ানে তেল বিক্রির চুক্তি পশ্চিমা বিশ্বকে পেট্রোডলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবাচ্ছে।

এর বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বায়নের বাধ দিনকে দিন ভেঙে যাচ্ছে। রাশিয়া তেল-গ্যাসের ব্যবসা করছে রুবলের মাধ্যমে। চীন ইউয়ানকে শক্তিশালী করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারত রুপিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিণত করতে চায় বলে জানিয়েছে দেশটির রিজার্ভ ব্যাংক।

এ অবস্থায় দিন যত যাচ্ছে ‍‍`জি-টু-জি‍‍` চুক্তিগুলো ততবেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। দেশগুলো ডলার বাদ দিয়ে নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা করতে আগ্রহী হচ্ছে। সম্প্রতি ইরান-রাশিয়া এমনই একটি চুক্তি করেছে যেখানে ডলার নয়, ব্যবসা হবে রিয়াল-রুবলের মাধ্যমে।

দেশভিত্তিক ব্যবসার বাইরেও, ব্রিকসের মতো সংগঠনগুলো ডি-ডলারিজেশন নিয়ে কাজ করছে।

মূলত পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য থেকে রেহাই পেতে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় দেশগুলো ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। ব্রিকসের মূল আকর্ষণ ডলারের একচেটিয়া বাজার থেকে বের হয়ে এসে আঞ্চলিক মুদ্রা ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা। এছাড়া ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক মুদ্রাকে গুরুত্ব দেয়াও ব্রিকসকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

এসব অর্থনৈতিক সুবিধার বাইরেও ব্রিকসের আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে, উদীয়মান শক্তিশালী রাজনৈতিক জোট গঠন। যেখানে চীন এবং রাশিয়া পশ্চিমাদের আধিপত্য অস্বীকার করে নিজেদের আলাদা একটি স্থান তৈরির সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, সেখানে নতুন এ ছায়াতলে অন্যান্য দেশও নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিতে চাচ্ছে।

ইকোনোমিস্টের প্রতিবেদন অনুসারে, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ব্রিকসে যোগ দিতে চাওয়ার মূল কারণ জ্বালানি তেলের নতুন বাজার সৃষ্টি করা। মূলত, আমেরিকা তথা পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হতে থাকার ফলশ্রুতিতে দেশ দুটি নিজেদের বিকল্প বাজার খুঁজছে ব্রিকসের মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে চীন এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের বাজারে নিজ মুদ্রায় জ্বালানি তেল বিক্রি এসব দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে আরও শক্ত ভিত দিতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো না হওয়ায় এসব দেশ নিজেদের রফতানি পণ্যের জন্য বিকল্প ভাবছে; যা ব্রিকসের মাধ্যমে পূরণ করা সহজ। বিশেষ করে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি গ্রাজুয়েশন হলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পাশাপাশি বহুপাক্ষিক বাণিজ্যের দুয়ার খুলবে ব্রিকস।

জ্বালানি তেল কী শঙ্কামুক্ত?
এই যখন ডলারের অবস্থা, অন্যদিকে শঙ্কার মধ্যে আছে খোদ জ্বালানি তেলও। বিশ্বের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে শিল্প-কারখানার ওপর ভর করে। আর শিল্প-কারখানার প্রধান খোরাক জ্বালানি তেল। এছাড়া বিদ্যুৎ কিংবা অস্ত্রের সূতিকাগারও এই জ্বালানি তেল। যেখানে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা তেল ছাড়া কল্পনা করা যায় না, সেখানেই এখন অস্তিত্বের প্রয়োজনে খুঁজতে হচ্ছে তেলের বিকল্প।

সম্প্রতি মতামতভিত্তিক সংবাদসংস্থা প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আলিনাজের প্রধান অর্থনীতিবিদ লুডোভিক সাবরান বলেন,আগামী বিশ্বে তেলের বিকল্প হবে নানা ধরনের ধাতু। এসব ধাতুর হাত ধরেই গ্রিন এনার্জির যাত্রা শুরু হবে বলে মনে করেন তিনি।

গ্রিন এনার্জির বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) থেকে শুরু করে বায়ুকলের যন্ত্রাংশের যোগান আসবে মূলত বিভিন্ন ধরণের ধাতব সম্পদ থেকে। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সির তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে ধাতুর বাজারের বিকিকিনি বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০৪০ সালের মধ্যে এ বাজারের ব্যাপকতা আরও কয়েকগুণ বাড়বে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরই মধ্যে ধাতব সম্পদ সংবলিত দেশগুলো ওপেকের আদলে নিজেদের একটি সংস্থা তৈরির কথা ভাবছে। ওপেক যেখানে জ্বালানি তেলের খবরদারি করে, সেখানে এবার ওমেক (অর্গানাইজেশন অব মেটাল এক্সপোর্টিং কান্ট্রিস) ধাতব সম্পদের খবরদারি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও ওমেক নিয়ে এখনও কোনো অফিশিয়াল বার্তা দেয়নি দেশগুলো। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, ব্রিকসভিত্তিক দেশগুলো এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বেশকিছু দেশ নিয়ে ওমেক গঠন করতে পারে।

কদিন আগেও বিশ্লেষকদের মতামত ছিল, পেট্রোডলারের পেট্রোলিয়াম ঠিকই থাকবে, শুধু পরিস্থিতি বিবেচনায় ডলারের বদলে যোগ হতে পারে অন্য কোনো মুদ্রা। কিন্তু ভবিষ্যৎ বিশ্বকে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডলার যেমনি বিপদের মুখে আছে, তেমনি ঘোলাটে পরিস্থিতি জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও। দিন যত যাচ্ছে ততই অস্তমিত হয়ে আসছে পেট্রোডলারে ডলার এবং তেল দুইটির একাধিপত্যের সূর্য।

 

সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন

 

জেকেএস/

অর্থ ও বাণিজ্য সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ