• ঢাকা শুক্রবার
    ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন

অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ‘ইকোনমিক্যাল নয়, পলিটিক্যাল’ হয়

প্রকাশিত: জুন ১৯, ২০২৩, ০২:৩২ এএম

অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ‘ইকোনমিক্যাল নয়, পলিটিক্যাল’  হয়

ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত ইকোনমিক্যাল না হয়ে অনেক ক্ষেত্রে পলিটিক্যাল হয়। এতে অনেক সময় দেখা যায়, দেশের অর্থনীতি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বদলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তমতে চলে।

রোববার (১৮ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

ঘোষিত নতুন মুদ্রানীতি নিয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, এবারের মুদ্রানীতি বিগত মুদ্রানীতির থেকে আলাদা। আগেকার মুদ্রানীতি মূলত টাকা সরবরাহের দিকে জোর দিয়ে প্রস্তুত করা হতো। এবারের মুদ্রানীতিতে টাকা সরবরাহ নয়; বরং মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহারের ওপর জোর দিয়ে করা হয়েছে।

এবারের মুদ্রানীতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ নীতি মেনে রিজার্ভের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে। এছাড়া পাশাপাশি প্রথাগত নীতি মেনেও রিজার্ভ নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি।

নতুন মুদ্রানীতি আইএমএফের শর্ত মেনে করা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘বিশ্বের যেসব দেশ আইএমএফের সদস্য; তাদের সবাইকে আইএমএফ নিজেদের রীতিগুলো মানার জন্য আহ্বান জানায়। বিশেষ করে ঋণ নিতে গেলে এসব রীতি মানতে হয়। যেখানে আইএমএফ থেকে ২ শতাংশ সুদে ঋণ নেয়া যায়, সেখানে বাকিদের সুদের পরিমাণ ৭ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে যেসব শর্ত মানলে কোনো ক্ষতি নেই, আইএমএফের সেসব শর্ত মানাই যেতে পারে।’

আইএমএফের শর্তানুযায়ী রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার থাকতে হবে এবং সেটা আদৌ সম্ভব হবে কি না, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘প্রথমত, আইএমএফের এই শর্তটিকে শিথিল করা হয়েছে। কেননা, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি রিজার্ভের টাকা ধরে রাখলাম আর গুরুত্বপূর্ণ খাতে টাকা দিলাম না তাতে কোনো লাভ হবে না। রোজার সময় পণ্য আমদানি কিংবা বিদ্যুতের জন্য জ্বালানি আমদানি–এসব ব্যাপারে টাকা ধরে রাখা মানে দেশে সংকট সৃষ্টি করা। প্রয়োজনমতো রিজার্ভ থেকে টাকা খরচ করা হবে।’

আব্দুর রউফ বলেন, ‘রিজার্ভের টাকা দিয়ে ঋণপত্র (এলসি) খুলে এখনও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। বিগত বছরে এত কড়াকড়ির পরও রেকর্ড পরিমাণ বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। এসব রুখতে লেন্ডিং হার বাড়িয়ে দেয়া হবে। এতে অপ্রয়োজনীয় আমদানির পরিমাণ কমে আসবে। এতদিনের যে লেন্ডিং রেট গ্যাপ ছিল, এটি কোনো অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয় বরং রাজনৈতিক।’

বিদেশের বাজারে আটকে থাকা রফতানির টাকার পরিমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেন ১০ বিলিয়ন ডলার রফতানির টাকা বিদেশের বাজারে আটকে আছে। প্রথমত, টাকার অঙ্ক দুই বিলিয়ন ডলার; দ্বিতীয়ত, এটি আটকে থাকা নয়। ১৮০ দিনের মধ্যে রফতানির টাকা দেশে আসার নিয়ম। সে হিসেবে এমন কোনো বড় অঙ্কের অর্থ আটকে নেই, যা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে।’

বর্তমান বাজারের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিগত মুদ্রানীতি ব্যর্থ হয়েছে কি না–এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, মুদ্রানীতি সফল বা ব্যর্থ হওয়ার বিষয় নয়। একটা মুদ্রানীতি কাজে না লাগলে পরের অর্থবছরে নতুন মুদ্রানীতি দেয়া হবে। সারা বিশ্বে এটাই নিয়ম। মুদ্রানীতি ব্যর্থ হয়েছে বলতে গেলে, চলতি অর্থবছরে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশের মুদ্রানীতি ব্যর্থ হয়েছে বলতে হবে।

সরকারি ঋণের ব্যাপারে আব্দুর রউফ বলেন, সরকার ঋণ নিলে যাতে ব্যয়বহুল হয়, নতুন মুদ্রানীতিতে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, ব্যাংক থেকে বাজেট অর্থায়নে সরকার যে ঋণ নেয় তা বেতন, ভাতা বা এ সংক্রান্ত কাজে ব্যয় হয় না। এসব টাকা খরচ হয় রিজার্ভ থেকে। অন্যদিকে ঋণের টাকা খরচ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে, যা একরকমের বিনিয়োগ।

এ ছাড়া সরকারকে ঋণ দিলে খেলাপির ভয় থাকে না বলেও জানান গভর্নর। তিনি বলেন, ‘সরকারি ঋণ একরকমের পরোক্ষভাবে প্রাইভেট খাতকে সুবিধা দিয়ে থাকে। যাতে প্রাইভেট খাত বিপদের মুখে না পড়ে, তাই সরকারি ঋণ বহাল রাখা জরুরি।’

আর দেশের বর্তমান অর্থনীতি নিয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, কোনোভাবেই বর্তমান অর্থনীতিকে দুর্বল অর্থনীতি বলা যাবে না। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেশের রেমিট্যান্স ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। পরিসংখ্যান দেখলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল হয়েছে এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।

নতুন টাকা ছাপানোর ব্যাপারে গভর্নর বলেন, টাকা ছাপানো মানেই যে খারাপ এমন কিছু না। কথা হচ্ছে ছাপানো টাকা কোন খাতে খরচ করা হচ্ছে তা নিয়ে। অনেক সময় তারল্য দেখা দিলে ব্যাংক বন্ড কিনে সেটা সামাল দেয়। মূলত বন্ড কেনা বা নানা মাধ্যমে সরকারকে ঋণ দিয়ে ব্যাংক একরকমের প্রাইভেট খাতকে সতেজ রাখার চেষ্টা করছে।

এ সময় বাংলাদেশের ৮টি ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে জানিয়ে তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক, আইসিবি ইসলামি ব্যাংক বা পদ্মা ব্যাংকের মতো আরও পাঁচটি ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্দেশ্য তাদের ব্যাংকিং ব্যবসায় টিকিয়ে রাখা। আশা করা যায়, এই ব্যাংকগুলো সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠবে।

শেয়ারবাজার নিয়ে রউফ বলেন, ‘শেয়ারবাজার বলতে সবাই ইকুইটি মার্কেটকে বুঝে থাকে। তবে আমরা এবার বন্ড মার্কেটের দিকে জোর দিচ্ছি। ইকুইটি মার্কেট থেকে বন্ড মার্কেট শক্তিশালী হলে শেয়ারবাজার আরও চাঙা হবে।’

চীন কিংবা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ নিজস্ব মুদ্রাবিনিময় রীতিতে যাচ্ছে কি না–এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, এখনও কোনো ধরনের কারেন্সি সোয়াপে যায়নি বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে রুপি দিয়ে বাণিজ্য করার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে জুলাই-আগস্টের দিকে বাজারে বাংলাদেশ একটি ক্রেডিট কার্ড আনতে যাচ্ছে যেটা ব্যবহারে ভারত ভ্রমণে মুদ্রা বিনিময়ের ঝামেলা থাকবে না। এখন কেউ ভারত যেতে চাইলে শুরুতে টাকাকে ডলারে রূপান্তর করতে হয়, পরে ভারত গিয়ে আবার ডলারকে রুপিতে আনতে হয়। পরপর দুবার মুদ্রা ভাঙানোর ফলে মুদ্রার মান কমে যায়। এই কার্ড ব্যবহারে গ্রাহকরা এ ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে।

 

জেকেএস/

আর্কাইভ