• ঢাকা রবিবার
    ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

প্রাইজবন্ডের পুরস্কারের টাকা পায় কয়জন?

প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২৩, ০২:৩৪ এএম

প্রাইজবন্ডের পুরস্কারের টাকা পায় কয়জন?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

সমাজের একটি অংশ ভাগ্যে বিশ্বাস করে। ভাগ্যে বিশ্বাসী মানুষের জন্য দেশে প্রাইজবন্ড আকারে সঞ্চয় কর্মসূচি চালু রয়েছে ১৯৭৪ সাল থেকে। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে সঞ্চয়প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য এটি চালু করে সরকার। এই সঞ্চয় কর্মসূচির নাম ‘বাংলাদেশ প্রাইজবন্ড’। এটি বিক্রি করে সরকার জনগণের কাছ থেকে সরাসরি ঋণ নেয়। প্রাইজবন্ড মূলত জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের একটি আর্থিক পণ্য। তবে এর সবকিছু দেখভাল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বছরে চারবার ঢাকা বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারের সভাপতিত্বে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিসের সম্মেলন কক্ষে ঘটা করে এর ড্র অনুষ্ঠিত হয়।

প্রাইজবন্ডে প্রতি সিরিজের জন্য ৪৬টি পুরস্কার রয়েছে, যার মূল্যমান ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রথম পুরস্কার একটি ৬ লাখ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার একটি ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা, তৃতীয় পুরস্কার দুটি ১ লাখ টাকা করে, চতুর্থ পুরস্কার দুটি ৫০ হাজার টাকা করে এবং পঞ্চম পুরস্কার ৪০টি ১০ হাজার টাকা করে।

অর্থাৎ বছরে প্রদত্ত পুরস্কারের মোট মূল্য দাঁড়ায় ৪৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

প্রতিবছরের ৩১ জানুয়ারি, ৩০ এপ্রিল, ৩১ জুলাই এবং ৩১ অক্টোবর প্রাইজবন্ডের ড্র অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে প্রতিবছর জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর মোট ১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৮২টি পুরস্কার ঘোষণা করে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন ওঠে প্রাইজবন্ডের পুরস্কারের টাকা পায় কয়জন?

বাংলাদেশ ব্যাংক ও সঞ্চয় অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ভাগ্য ফেরানোর জন্য প্রবল আগ্রহ নিয়ে অনেকেই প্রাইজবন্ড কিনলেও ড্রয়ের ফলাফল মিলিয়ে দেখার ব্যাপারে অনেকের আলস্য থাকে। গাফিলতি করে অনেকেই প্রাইজবন্ডের নম্বর মিলিয়ে দেখেন না। ফলে পাওয়া পুরস্কারও নিতে পারেন না অনেকে।

সঞ্চয় অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, প্রাইজ বন্ড লটারি চালু হওয়ার পর থেকে পুরস্কারের একটি ভালো পরিমাণ অর্থের দাবিদার পাওয়া যায়নি।

এদিকে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য বলছে,  প্রাইজ বন্ড বিজয়ীদের পুরস্কার দাবি না করা গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে। বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন, সুন্নতে খতনা, র‌্যাফেল ড্র- এসব অনুষ্ঠানে প্রাইজবন্ড উপহার দেয়ার বেশ প্রচলন রয়েছে।

পুরস্কারের অর্থ যখন সরকারি কোষাগারে ফেরত যায়
সাধারণত, প্রাইজ বন্ড বিজয়ীরা ফলাফল প্রকাশের ২ বছরের মধ্যে যথাযথ নিয়ম মেনে পুরস্কারের অর্থ দাবি না করলে সে পরে পুরস্কারের অর্থ তামাদি হয়ে সরকারি কোষাগারে ফেরত যায়।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের পরিচালক শাহ আলম বলেন, পুরস্কারের অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে দাবি জানাতে হয়। বিজয়ী প্রাইজ বন্ডসহ আবেদন করলে ভোগান্তি ছাড়াই পুরস্কারের টাকা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এত দিন ফলাফল মিলানো বেশ ঝামেলার বিষয় ছিল। সম্প্রতি প্রাইজ বন্ড রেজাল্ট ইনকোয়ারি সফটওয়্যার (পিবিআরআইএস)’ নামে একটি সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে গ্রাহক সহজে জানতে পারবে তিনি বিজয়ী কিনা। আশা করছি, প্রাইজবন্ডের লটারির পুরস্কারের ফলাফল খুঁজে বের করা সহজ হলে দাবিদার বাড়বে।

জানা গেছে, এতো দিন অনেকেই ফলাফলের সঙ্গে ৭ সংখ্যার প্রাইজ বন্ড নম্বর মিলাতো না। ক্রেতাদের অনেকেই বলেছেন, নিখুঁত ভাবে মিলানো একটি কঠিন কাজ ছিল, তাই হয়তো অনেকেই আগ্রহ দেখায়নি। অনেকে ফলাফল দেখতে ভুলে যান বা প্রাইজ বন্ড হারিয়ে ফেলেন। যে কারণে গ্রাহকদের একটি অংশ পুরস্কার দাবি করেন না।

দীর্ঘদিন ধরে লটারির ফল শুধু সংবাদপত্রেই প্রকাশ হতো। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে একটি সার্চ অপশন যোগ করা হয়। সংবাদপত্র বা ওয়েবসাইটে প্রাইজ বন্ডের ফলাফল খোঁজার ঝামেলা কমাতে সরকার সম্প্রতি পিবিআরআইএস  সফটওয়্যার তৈরি করেছে।

নিয়ম অনুযায়ী, একজন গ্রাহককে প্রাইজবন্ড কেনার পর অবশ্যই প্রতি তিন মাস পরপর অনুষ্ঠিত ড্রয়ের ফলাফলের সঙ্গে বন্ড নম্বরগুলি মিলিয়ে নিতে হবে। তা না হলে প্রাইজবন্ডের পুরষ্কারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন।

জাতীয় সঞ্চয় বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে  ৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪০ কোটি ৪১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ডিসেম্বরে শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ১৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

সহজে ফলাফল মিলানোর সুযোগ
প্রাইজবন্ডের ফল জানতে পিবিআরআইএস ওয়েবসাইটের ই-সেবায় প্রবেশ করতে হবে। এরপর সার্চ বক্সে বাংলা বা ইংরেজিতে সরাসরি প্রাইজবন্ডের নম্বর লিখলে ফল চলে আসবে।

ফল অনুসন্ধান করা যাবে দুইভাবে। একাধিক নম্বর একসঙ্গে অনুসন্ধান করতে হলে কমা (,) দিয়ে নম্বরগুলো লিখতে হবে। সিরিজ নম্বরের ক্ষেত্রে প্রথম ও শেষ সংখ্যার মাঝে হাইফেন (-) দিয়ে অনুসন্ধান করা যাবে।

তাছাড়া মাইক্রোসফট এক্সেল ফাইল আপলোড করেও ফল জানা যাবে। যেমন- একজনের কাছে যদি অনেকগুলো প্রাইজবন্ড থাকে, তিনি ওই নম্বরগুলো একটি মাইক্রোসফট এক্সেল শিটে দিয়ে রাখবেন।

প্রাইজ বন্ডের যখন লটারি হবে, তখন ওই ফাইলটি ওয়েবসাইটে আপলোড করলে তার মধ্যে কোনও নম্বর জিতলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখাবে।

বর্তমানে এই ওয়েবসাইটে সর্বশেষ দুই বছরের লটারির তথ্য পাওয়া যাচ্ছে । দেশে বর্তমানে ৬৭টি সিরিজের প্রাইজবন্ড রয়েছে। প্রতিটি সিরিজ থেকে ৪৬টি করে পুরস্কার দেওয়া হয়।

বিশ্বে প্রথম প্রাইজবন্ড চালু হয় ১৯৫৬ সালে আয়ারল্যান্ডে। বাংলাদেশে প্রথম চালু হয় ১৯৭৪ সালে। তবে তখন ছিল ১০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ড। ১৯৮৫ সালে চালু হয় ৫০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ড। ১৯৯৫ সালে ১০০ টাকা মূল্যমানের প্রাইজবন্ড চালু হওয়ার পর ১০ টাকা ও ৫০ টাকা মূল্যমানের বন্ডগুলো সরকার তুলে নিয়ে মূল্য সংশোধিত করে ১০০ টাকা করা হয়।

যেভাবে পুরস্কারের টাকা পাওয়া যায়
বাণিজ্যিক ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং স্থানীয় পোস্ট অফিসগুলো প্রাইজ বন্ড বিক্রি করলেও  ড্রয়ের পর মূল বন্ডসহ নির্ধারিত ফরমে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করলে সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে বিজয়ীকে পে-অর্ডার দেওয়া হয়। প্রাইজবন্ডের লটারির টাকায় সরকার নির্ধারিত ২০ শতাংশ আয়কর কেটে রাখা হয়।

জানা গেছে, দেশে ৫ কোটি পিসের মতো প্রাইজবন্ড রয়েছে। এতে সুদের কোনও ব্যাপার নেই। যেকোনো সময় এ প্রাইজবন্ড ভাঙিয়ে টাকা ফেরত নেওয়া যায়। ভাঙানো ও কেনা—দুটোই করা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সব ক্যাশ অফিস, যেকোনও বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ডাকঘর থেকে।

প্রাইজবন্ডের পুরস্কারের পেছনে অসাধু চক্র
প্রাইজবন্ডের পুরস্কারের পেছনে একটি অসাধু চক্র কাজ করছে বলে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎকালীন সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর একটি চিঠি দিয়েছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, প্রায়ই দেখা যায়, প্রাইজবন্ডের লটারিতে পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তি নিজে পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ না করে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। এভাবে ওই ব্যক্তি অবৈধ অর্থ বৈধ করার সুযোগ পেয়ে যান। এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা দরকার।

কালো টাকা সাদা দেখানোর কৌশল
সাধারণত, প্রাইজবন্ড যার কাছে থাকে, মালিকানা তারই। আবার লটারির দুই বছরের মধ্যে যিনি পুরস্কার পাওয়া বন্ড নিয়ে হাজির হবেন, তিনিই টাকা পাবেন। এই সুযোগ থাকায় ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে যারা অবৈধ টাকা উপার্জন করেন, তাদের একটি অংশ লটারিতে জেতা প্রাইজবন্ড কিনছেন। নিজের নামে অথবা স্ত্রী-সন্তানের নামে লটারিতে পাওয়া অর্থ হিসেবে আয়কর ফাইলে দেখাচ্ছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি চিঠিতে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বছর দুয়েক আগে দুদক বাংলাদেশ ব্যাংককে এই অপরাধ বন্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর পাঠানো দুদকের  চিঠিতে বলা হয়, প্রায়ই দেখা যায় প্রাইজবন্ডের লটারিতে পুরস্কার বিজয়ী ব্যক্তি নিজে পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ না করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। এভাবে ওই ব্যক্তি অবৈধ অর্থ বৈধ করার সুযোগ পেয়ে যায়। এ ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন।

অর্থ ও বাণিজ্য সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ