প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৩, ০৬:৫০ পিএম
ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার সংকট, বাজারে তদারকি না থাকায় ও মূল্য নির্ধারণ না করায় লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক পোলট্রি খামার। গত দুই বছরে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় প্রায় সাড়ে ৮ হাজার পোলট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে খামারির সঙ্গে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষজন। এভাবে চলতে থাকলে এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন উদ্যোক্তারা।
এ অবস্থায় পোলট্রি খাতকে বাঁচাতে যত দ্রুত সম্ভব সরকারিভাবে মূল্য নির্ধারণ, বাজার তদারকি নিশ্চিত ও মুরগির বাচ্চার সংকট নিরসনের দাবি উঠেছে। একইসঙ্গে উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
যে সব কারণে বেড়েছে মুরগির দাম
খামারিরা জানিয়েছেন, মূলত তিন কারণে বেড়েছে মুরগির দাম। প্রথমত ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার সংকট, দ্বিতীয়ত পোলট্রি খাদ্য, ওষুধের দাম ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। তৃতীয়ত সিন্ডিকেট।
তারা বলছেন, পোলট্রি খাদ্য তৈরিতে ভুট্টা, সয়ামিলসহ বিভিন্ন কাঁচামালের প্রয়োজন হয়। পোলট্রি শিল্পের প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। পোলট্রি খাদ্য, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, সে কারণে ডিম ও মুরগির দাম বেড়েছে।
ব্রয়লার প্যারেন্টস মেরে ফেলায় উৎপাদন কমেছে
পোলট্রি শিল্প-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা হ্যাচারি মালিকরা লোকসানের কারণে ব্রয়লার প্যারেন্টস মেরে ফেলায় বাচ্চা উৎপাদন কমে গেছে। যেখানে বরিশাল নগরীতে প্রতিদিন ব্রয়লারের এক লাখ বাচ্চা প্রয়োজন, সেখানে আসছে ১৫-১৬ হাজার। যা নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন খামারিরা। ফলে বেড়ে গেছে মুরগির বাচ্চার দাম।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে মুরগির খামার দিয়েছেন খামারিরা। বাসাবাড়ির নিচতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে লেয়ার, ব্রয়লার ও সোনালি মুরগি লালনপালন করছেন তারা। কিন্তু সরকারি তদারকি না থাকায় ও মূল্য নির্ধারণ না করায় লোকসানে পড়ছেন ছোটবড় সব খামারি। এ অবস্থায় বড় খামারিরা অল্প মুরগি কিনে কোনোভাবে ব্যবসা ধরে রেখেছেন। তবে ছোট খামারিরা বাচ্চা তোলা বন্ধ করে খামার বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউ কেউ এখনো খামার বিক্রির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হ্যাচারি মালিক জানিয়েছেন, পোলট্রি খাদ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। সেইসঙ্গে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। কিন্তু মুরগির বাচ্চার দাম তেমন বাড়েনি। এতে লোকসানে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন হ্যাচারি মালিকরা। বছরের পর বছর এভাবে চলায় ব্রয়লার প্যারেন্টস মেরে ফেলেছেন অনেক খামারি। তারা এখন আর ব্রয়লারের বাচ্চা উৎপাদন করছেন না। এ কারণে সংকট দেখা দিয়েছে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার। এখন বাজারে যে পরিমাণ বাচ্চা আসছে, তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
তিনি আরও জানিয়েছেন, শুধুমাত্র বরিশাল নগরীতে চাহিদা রয়েছে এক লাখ ব্রয়লার বাচ্চার। সেখানে আসছে মাত্র ১৫ হাজার। এ জন্য অনেক খামারি খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। কম আসায় বাচ্চার দাম বেড়ে গেছে।
খামার বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক খামারি
নগরীর খামারি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘গত এক বছর ধরে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার সংকট চলছে। মাসের পর মাস লোকসান দিতে দিতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। যে পরিমাণ মুরগির বাচ্চার আসছে, তা দিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি খামার চালানো সম্ভব। বাকিগুলো শূন্য থাকে। আবার এসব বাচ্চার দাম অনেক বেশি। কোনোভাবেই পোষাতে পারছি না। এজন্য খামার বন্ধ করে দিয়েছি।’
লোকসানে পড়ে নিজের দুটি ব্রয়লার মুরগির খামার বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানালেন নগরীর কাশিপুরের ডেফুলিয়ার খামারি মুরাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘দুটি খামারের ঘর তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। এরপর বাচ্চা কিনে লালনপালন শেষে বাজারে বিক্রির জন্য দেয়া পর্যন্ত ছয় লাখ টাকা ব্যয় করেছি। এর সঙ্গে শ্রম তো ছিলই। কিন্তু আয় হয়েছে মাত্র আড়াই লাখ টাকা। বাকি টাকা লোকসান। এক মাস আগে খামার দুটি বন্ধ করে ঘরগুলো ধোয়ামোছা করে রেখে দিয়েছি।’
মুরাদ হোসেন আরও বলেন, ‘আমার মতো এই এলাকায় অন্তত ২০-২৫টি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছেন। এখনও অনেকে খামার বিক্রি করছেন। তাতেও খরচ উঠছে না। এজন্য খামারিদের সঙ্গে বেকার হয়ে পড়েছেন শ্রমিক ও কর্মীরা।’
আরও দাম বাড়ার শঙ্কা
এ অবস্থায় মুরগির দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করে বাংলাবাজারের মুরগি বিক্রেতা মো. আরমান বলেন, ‘ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার সংকট, পোলট্রি খাদ্য, ওষুধের দাম ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে খামারিদের। এ জন্য হঠাৎ মুরগির দাম বেড়ে গেছে। এই সংকট চলতে থাকলে আগামী ঈদে ৩০০ টাকা কেজি দরে মুরগি কিনতে হবে। তাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।’
যে সব পদক্ষেপ নিলে কমতে পারে মুরগির দাম
সংকট নিরসনে তিন পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের বরিশাল বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক এনায়েত হোসেন শুভ। সেগুলো হলো- সরকারিভাবে মূল্য নির্ধারণ, পোলট্রি খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি নিশ্চিত ও মুরগির বাচ্চার উৎপাদন বাড়াতে হবে।
পোলট্রি খামার দিয়ে গত পাঁচ বছরে ৪০ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে উল্লেখ করে এনায়েত হোসেন শুভ বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে পোলট্রি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছি। নগরীতে নিজস্ব জমির ওপর নির্মিত তিনতলা ভবনে লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগি লালনপালন করেছিলাম। এ জন্য ছয় জন কর্মচারী রেখেছিলাম। ইতোমধ্যে ৪০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। তিনতলা ভবনের দোতলা লেয়ার মুরগিতে পরিপূর্ণ ছিল। লোকসানের কারণে লেয়ার মুরগি পালন বন্ধ করে দিয়েছি।’
ব্যক্তি উদ্যোগে পোলট্রি শিল্প সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে এনায়েত হোসেন শুভ বলেন, ‘সরকার থেকে এখন পর্যন্ত এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের কোনো ধরনের সহায়তা দেয়া হয়নি। এক-দুই জন করে ধীরে ধীরে বিভাগের ছয় জেলায় ছোটবড় সাড়ে ১৪ হাজার খামারি তৈরি হয়েছিল। প্রতি খামারে তিন জন করে কর্মচারী ধরলেও ৪৩ হাজার ছিলেন। এর মধ্যে গত দুই বছরে করোনা এবং ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা সংকট, পোলট্রি খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সাড়ে আট হাজার খামার। এতে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত বড় একটি অংশ বেকার হয়ে পড়েছেন।’
এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে মূল্য নির্ধারণের বিকল্প নেই বলেও জানান এনায়েত হোসেন শুভ। তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি সরকারি তদারকি বাড়াতে হবে। এতে বন্ধ খামার আবার সচল হবে। নতুন খামার গড়ে উঠবে। বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। উচ্চশিক্ষিত বেকাররাও এই শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবে।’
ভালো অবস্থানে আছেন মুরগি এবং ডিম বিক্রেতারা
এনায়েত হোসেন শুভ আরও বলেন, ‘পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনকারীরা শতকরা ১২ টাকা কমে ব্যবসায়ীদের খাবার সরবরাহ করছেন। ওই টাকা শেষ পর্যন্ত ক্রেতার ওপর গিয়ে পড়ছে। একইভাবে ওষুধের দামও বেড়েছে। খামারিরা পড়েছেন বেকায়দায়। এ ছাড়া ঢাকায় মুগরি বিক্রি করতে গেলে কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা করে আড়তদারি দিতে হয়। কিন্তু সেখানে গাড়িতে বসে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করা হচ্ছে। আড়তাদারির টাকা ক্রেতার কাছ থেকে তোলা হচ্ছে। তবে এসবের মধ্যেও ভালো অবস্থানে আছেন মুরগি এবং ডিম বিক্রেতারা। তারা যে পরিমাণ মুনাফা পান, তা কিন্তু খামারি এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা পান না।’
এনায়েত হোসেনের খামারের ব্যবস্থাপক মো. শাহিন বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে খামারের মুরগি লালনপালন ও দেখাশোনা করে আসছি। খামারে ওই সময় লেয়ার মুরগি ছিল ২০ হাজার। লোকসানের কারণে এখন সাত হাজার মুরগি আছে। আগে এক বস্তা খাবার কিনতাম দেড় হাজার টাকায়, এখন কিনছি সাড়ে তিন হাজার টাকায়। দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে ওষুধ। কিন্তু সেভাবে ডিম এবং মুরগির দাম বাড়েনি। তবে এখন যে দাম চলছে, তা কিন্তু অস্বাভাবিক।’
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের বরিশাল বিভাগীয় সভাপতি আব্দুর রহিম গাজী বলেন, ‘আমার চারতলা ভবনের দুই ফ্ল্যাটে ১২ হাজার লেয়ার মুরগি লালনপালন করছি। ব্যবসায় তিন কোটি টাকা বিনিয়োগ। কিন্তু হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে দেখি লাভ তো দূরের কথা মূলধনই কমে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে মূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়েছি। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে সরকার থেকে মূল্য নির্ধারণ কমিটি গঠিত হয়েছিল। তার কোনও অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে পোলট্রি খাত। দ্রুত এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’