প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০২২, ০৬:৫১ পিএম
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, আলেশা মার্টের ব্যাংক হিসাবে দুই হাজার এক কোটি ২৮ লাখ টাকা ছিল। কিন্তু সেখান থেকে এক হাজার ৯৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এখন উত্তোলনকৃত এই টাকার কোনো হদিস মিলছে না। বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদারও।
মঞ্জুর আলম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থপাচারের যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও মামলা না করায় অনুসন্ধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলীকে।
ফলে এবার অর্থপাচারের মামলা হচ্ছে আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুর আলম শিকদার ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যেই পরিবর্তন করা হয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) আলেশা মার্ট বিষয়ক তদন্ত কর্মকর্তা। মঞ্জুর আলম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থপাচারের যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও মামলা না করায় অনুসন্ধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয় সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলীকে। আলেশা মার্ট প্রধানের সঙ্গে তার গোপন সখ্যতা ও লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে। এসব বিষয় নিশ্চিত করেছে সিআইডি সূত্র।
সিআইডির ডিআইজি মো. হাবিবুর রহমান সিটি নিউজ ঢাকাকে জানান, ‘নতুন করে একজন এএসপি মর্যাদার কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে অনুসন্ধান চলমান আছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই অনুসন্ধান শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া মঞ্জুর আলম এতদিন গোপন লেনদেনের মাধ্যমে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেছিলেন বলে উঠে এসেছে সরকারি একাধিক সংস্থার অনুসন্ধানে।
গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া মঞ্জুর আলম এতদিন গোপন লেনদেনের মাধ্যমে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেছিলেন বলে উঠে এসেছে সরকারি একাধিক সংস্থার অনুসন্ধানে। একজন পদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘বিষয়টি শুরু থেকেই আমাদের নজরে ছিল। তবে আলেশা মার্ট চেয়ারম্যানকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না কেনো?- এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার আমলনামা আমাদের হাতে এসেছে। যারা কিনা এমন একজন প্রতারককে এতদিন ধরে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
ইভ্যালি, ধামাকা শপিং, ই-অরেঞ্জ, কিউকম এবং অন্যান্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম নিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে অনেক প্ল্যাটফর্মই মালিকদের স্বার্থে গ্রাহকের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এবার আলেশা মার্টের বিষয়টি সামনে এল।
প্রতারণার অভিনব কৌশল মঞ্জুর আলমের:
সাধারণ গ্রাহকদের বোকা বানানোয় জুড়ি মেলা ভাড় আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুর আলমের। তিনি গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে তৈরি করতেন চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন। মোটরবাইক, ইলেট্রনিক্স ও হোম এপ্লায়েন্সের মতো পণ্যে দিতেন ৩০-৩৫ শতাংশ ছাড়। এমন লোভনীয় অফারে হুমড়ি খেয়ে পড়তেন সাধারণ ক্রেতারা।
গ্রাহকদের বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করতে তিনি ৩২ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হওয়ার পাশাপাশি ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে নিয়মিত আকর্ষণীয় সব বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেন।
শুধু তাই নয়, গ্রাহকদের বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করতে তিনি ৩২ কোটি ৫৫ লাখ টাকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হওয়ার পাশাপাশি ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসানকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে নিয়মিত আকর্ষণীয় সব বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেন। আলেশা মার্টে বিজ্ঞাপনে ছেয়ে ফেলেন রাজধানী ঢাকা এবং বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামে চলাচল করা সিংহভাগ ট্যাক্সিক্যাব।
দেশের ক্রিকেটপ্রেমী জনগণ প্রিয় দলের খেলা দেখতে গেলেই মাঠের বাউন্ডারিতে চোখে পড়তো আলেশা মার্টের বিজ্ঞাপন। ব্যস্ত নগরীতে বের হলেই চোখে পড়তো আলেশা মার্টের বিজ্ঞাপন নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ট্যাক্সিক্যাব। এছাড়া টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, পত্রিকা ও অনলাইন প্রচারণা তো আছেই। কখনও কী কেউ ভেবেছে- এমন একটি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে রয়েছে প্রতারণার উদ্দেশ্য?
সাঈদ হাসান নামে একজন প্রতারিত গ্রাহক সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ‘আলেশা মার্ট যেভাবে একের পর এক বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছিল সেখানে তখন আস্থাহীনতার কোনো প্রশ্নই দেখা দেয়নি। বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ আসেনি মনের মধ্যে। ছোট কোনো কোম্পানি ক্রিকেটের মতো এত বড় প্লাটফর্মে স্পন্সর করতে পারে? এই বিশ্বাস থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছি।’
মঞ্জুর আলমের যত কথা, যত প্রতিশ্রুতি :
আলেশা গ্রুপের নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এক ডজনের বেশি। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মুনাফা অর্জন করায় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে কয়েকশ কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে দাবি করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। তার মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আলেশা মার্টের কার্যক্রমে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে দাবি করেন তিনি। মঞ্জুর আলম শিকদার তার গ্রাহকদের বলেই যাচ্ছেন, তিনি সবার পাওনা পরিশোধ করবেন। তবে খুব শীঘ্রই এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান আরও দাবি করেন, তার প্রতিষ্ঠানটি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মতো নয়। আলেশা মার্ট গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের আন্তরিক চেষ্টা চলছে।
তবে তার এসব প্রতিশ্রতির বাস্তবায়ন দেখা যায়নি গত প্রায় এক বছরে। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে হয়েছে অসংখ্য মামলা। জারি হয়েছে শতাধিক গ্রেফতারি পরোয়ানা। কিন্তু গ্রাহকদের কাছ মেরে দেয়া টাকা দিয়ে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে- এমনটাই মনে করছেন আলেশা মার্টের প্রতারিত গ্রাহকরা।
মঞ্জুরুল আলম সিকদার দাবি করেন, আলেশা মার্টের কাছে মাত্র সাত হাজার গ্রাহকের পাওনা রয়েছে। পাওনার পরিমাণ কম এমন গ্রাহকদের প্রাধান্যের ভিত্তিতে অর্থ পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছে। এর আগে নীতিগত পরিবর্তনের কারণে প্রতিষ্ঠানের অর্থ পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকা পড়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তবে কী পরিমাণ অর্থ আটকে আছে তার উল্লেখ করেননি।
আলেশা মার্টের সর্বশেষ ক্যাম্পেইনের ৪৫ হাজার মোটরসাইকেলের অর্ডার আসার ডেলিভারি লিস্ট প্রকাশ করে। গত বছরের জুন মাসে ক্যাম্পেইনটি শেষ হয়। এসব পণ্যের আনুমানিক মূল্য কয়েকশো কোটি টাকা। যা অগ্রিম হিসেবে গ্রাহকদের কাছে থেকে তুলে নেয় আলেশা মার্ট। সেসব অর্ডারের কোনো ডেলিভারি দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি, ফেরত দেয়নি অগ্রিম প্রদত্ত টাকাও।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যত ব্যবস্থা :
দেশে ই-কমার্সের আড়ালে পঞ্জি স্কিমের পথিকৃৎ বলা যায় ইভ্যালিকে। কয়েকশো কোটি টাকা দেনা, গ্রাহকদের মামলা ও শেষ পর্যন্ত মালিকদের গ্রেফতার- এভাবে ভেঙে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
বিরাট পরিমাণ দেনা ছাড়াও অর্থ পাচারের পর একই অবস্থা হয়েছে ধামাকা শপিংয়েরও। কোম্পানিটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন, দেশ ছেড়ে পালিয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ডিসকাউন্টের দিক থেকে অন্যান্য সমস্ত প্ল্যাটফর্মকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ই-অরেঞ্জ। গ্রাহকদের কাছে কয়েকশ কোটি টাকা দায় আছে কোম্পানিটির, প্রতিষ্ঠাতারাও জেলে। কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ভাই পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালানোর সময় ভারতে গ্রেফতার হন।
একজন গ্রাহক আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পর কিউকমের প্রতিষ্ঠাতা রিপন মিয়া ও কোম্পানিটির মার্কেটিং প্রধান গ্রেফতার হন। রিপন মিয়া দাবি করছিলেন, পেমেন্ট গেটওয়ে ফোস্টারপে-তে তার যতো টাকা আটকে আছে সে তুলনায় তার দেনা খুবই কম। ফোস্টারের প্যারেন্ট কোম্পানি এসএসডি টেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্তের কারণে বিএফআইইউ ফোস্টারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেয়।
এছাড়াও আনন্দ বাজার, দালাল প্লাস, বুমবুম, পারপ্লেক্স বিডি, শপেটিকসহ এক ডজনেরও বেশি একই রকম প্ল্যাটফর্ম। গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ নিয়ে দীর্ঘ সময় পর পণ্য ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দিত কোম্পানিগুলো। ইভ্যালি এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই দশা হয় এসব কোম্পানিরও। গ্রাহকদের শূন্য করে বন্ধ হয়ে যায় সব কার্যক্রম।
আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় তাদের সবার বিরুদ্ধে। সেখানে শুধু ব্যতিক্রম আলেশা মার্ট। তুলনামূলক বেশি গ্রাহক ও বেশি পরিমাণ টাকা প্রতারণা করেও আইনের আওতায় আসছেন না তিনি। এরপরও রয়েছে অর্থপাচারের তথ্য! তিনি রীতিমত ঘুরছেন-ফিরছেন, ফেসবুক লাইভে আসছেন পূর্ব ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু পুলিশ বলছে- মঞ্জুর আলমকে খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। তবে এবার আইনের হাত বেশি লম্বা নাকি মঞ্জুর আলমের হাত- সেটাই দেখার অপেক্ষা করছেন আলেশা মার্টের প্রতারিত গ্রাহকরা।
এআরআই