প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০২২, ১১:১২ পিএম
দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থপাচারের ঘটনা নতুন নয়। আগেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের তথ্য পেয়েছে সরকারি একাধিক সংস্থা। নেয়া হয়েছে সে ব্যবস্থাও। আর এই অর্থগুলোর বেশিরভাগ পাচার করা হয়েছে অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে। এবার সেই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হতে পারে বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের নাম। সরকারের একটি সংস্থার পক্ষ থেকে এমনই ইঙ্গিত মিলেছে।
অর্থপাচারে জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে আমরা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সম্পদের হিসাব তলব করেছি। বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তাই এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। উপযুক্ত সময়ে আমার গণমাধ্যমের কাছে বিষয়টি তুলে ধরবো। -সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির।
অর্থপাচারে সম্পৃক্ত রয়েছে এমন আরও ১০ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এমনটাই জানিয়েছেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারে সম্পৃক্ত থাকার প্রাথমিক তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। আমরা সেই সূত্র ধরে আমাদের তদন্ত চলমান আছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
আলেশা মার্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অর্থপাচারে জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে আমরা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সম্পদের হিসাব তলব করেছি। বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তাই এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। উপযুক্ত সময়ে আমার গণমাধ্যমের কাছে বিষয়টি তুলে ধরবো।’
চলতি বছরের মে মাসে আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুর আলম শিকদার এবং তার স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরীর সম্পদের হিসাব তলব করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। চিঠিতে বলা হয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পণ্য বিক্রয়ের নামে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার মাধ্যমে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন- ২০১২ এর সম্পৃক্ত অপরাধের প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অনুসন্ধানটির সুষ্ঠ তদন্ত ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের স্বার্থে অভিযুক্ত আলেশা মার্টের প্রধান মঞ্জুর আলম শিকদার, সাদিয়া চৌধুরী, আলেশা হোল্ডিংস লিমিটেড, আলেশা কার্ড ও আলেশা মার্ট -এর নিবন্ধিত সকল প্রকার সম্পত্তি ও মোটরযানের তথ্য প্রয়োজন। তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এসব তথ্য চাওয়া হয়।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘আলেশা মার্টের বিষয়টি আমরা বেশ কিছুদিন যাবত পর্যবেক্ষণ করছি। ইতোপুর্বে প্রতিষ্ঠানটির প্রধানকে মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ততার প্রাথমিক তথ্য পাওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সিআইডি। সেই সূত্র ধরে আমরা এখন কাজ করছি এবং হুন্ডির বিষয়টি সামনে এসেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’
এদিকে আলেশা মার্টের প্রতারিত গ্রাহকরা বলছেন, লোভনীয় অফারে হাজারো গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুর আলম শিকদার। তিনি যদি এই টাকা পাচার না করে থাকেন তাহলে গ্রাহকদের পাওনা ফেরত দিচ্ছেন না কেনো? এতে এটা প্রমাণ হয়- তিনি এই টাকাগুলো পাচার করেছেন। তার বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।
চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন আর বিশাল ছাড়ের অফার দিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের অনেকটা বোকা বানিয়েছে ‘হায় হায় কোম্পানি’ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। ৩০-৩৫% ডিসকাউন্টে মোটরসাইকেলসহ নানা রকম পণ্য দেয়ার কথা বলে বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। এই হাতিয়ে নেয়া টাকা পরবর্তীতে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে আত্মসাৎ করেছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষ। কেউবা বিদেশে গিয়ে করছেন আয়েশি জীবনযাপন, আবার কেউবা দেশে থেকেই বিভিন্ন দফতরকে ম্যানেজ করে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ক্ষতি যা হওয়ার তা শুধু অসহায় গ্রাহকদের!
প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু হুন্ডির মাধ্যমেই ৭০৫ কোটি টাকা পাচার করেছে। এদের মধ্যে আনন্দের বাজার নামের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ৩০০ কোটি, ই-অরেঞ্জ ২৩২ কোটি, ধামাকা ১১৬ কোটি, রিং আইডি ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ, টোয়েন্টি ফোর টিকিট লিমিটেড ৪ কোটি ৪৪ লাখ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১ কোটি ১৭ লাখ, সিরাজগঞ্জ শপ ৪ কোটি ৯ লাখ, আকাশনীল ডট কম ৩ কোটি টাকা।
এর আগে ৮ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের প্রমাণ পায় পুলিশের অপরাদ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। জানা যায়, এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু হুন্ডির মাধ্যমেই ৭০৫ কোটি টাকা পাচার করেছে। এদের মধ্যে আনন্দের বাজার নামের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ৩০০ কোটি, ই-অরেঞ্জ ২৩২ কোটি, ধামাকা ১১৬ কোটি, রিং আইডি ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ, টোয়েন্টি ফোর টিকিট লিমিটেড ৪ কোটি ৪৪ লাখ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড ১ কোটি ১৭ লাখ, সিরাজগঞ্জ শপ ৪ কোটি ৯ লাখ, আকাশনীল ডট কম ৩ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দালাল ডট কম ও থলে ডট কমেরও অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, টাকা দিয়ে পণ্য না পেয়ে গত বছরের আগস্ট মাস থেকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করেন প্রতারণার শিকার গ্রাহকেরা। পরে ১৪টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে আটটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সিআইডি বাদী হয়ে মামলা করে। অনুসন্ধান চলাকালে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়।
গ্রাহকের প্রতারণার মামলায় গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেলকে তার স্ত্রীসহ গ্রেফতার করে র্যাব। গত এপ্রিল মাসে রাসেলের স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন জামিনে মুক্তি পান। পরবর্তীতে আরেক মামলায় শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। সেই সঙ্গে মেহেদী হাসান নামে এক গ্রাহকের মামলায় রাসেল-শামীমা দম্পতির সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন আদালত।
এ ছাড়া প্রতারণা করে গ্রাহকদের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা থেকে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান এবং সিওও (প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা) আমানুল্লাহকে গ্রেফতার করা হয়। তবে দেশ থেকে পালিয়ে যান ই-অরেঞ্জের নেপথ্যে থাকা ব্যক্তি তৎকালীন বনানী থানার পরিদর্শক সোহেল রানা।
এখনও প্রতারণার জাল বিছিয়েই যাচ্ছেন আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার। তবে অন্যসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হলেও আলেশা মার্টের বেলায় সেই তৎপরতায় অনেকটা ভাটা পড়েছে। সারা দেশে শতাধিক গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও গ্রেফতার করা হচ্ছে না মঞ্জুর আলম শিকদারকে।
এত কিছুর পরেও থেমে নেই ই-কমার্সের প্রতারণা। এখনও প্রতারণার জাল বিছিয়েই যাচ্ছেন আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার। তবে অন্যসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হলেও আলেশা মার্টের বেলায় সেই তৎপরতায় অনেকটা ভাটা পড়েছে। সারা দেশে শতাধিক গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও গ্রেফতার করা হচ্ছে না মঞ্জুর আলম শিকদারকে।
অর্থ পাচার ঠেকাতে আগে হুন্ডি বন্ধের দাবি :
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সম্প্রতি বলেছে, বিকাশ-নগদ ও রকেটের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে অর্থ আনা ও বিদেশে অর্থ পাঠানোয় জড়িত। তাদের মাধ্যমে চার মাসে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) বিতরণ হয়েছে। এভাবে দেশ বছরে প্রায় ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
হুন্ডি কেনো হয় :
হুন্ডি তখনই সংঘটিত হয়, যখন কেউ দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে বিদেশে অর্থ পাঠাতে চায়, আর বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় পাঠাতে চায়, তা হাতে হাতে বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় পাঠাতে চায়, তা বিদেশেই থেকে যায়। সেই অর্থ পাচারকারীদের হাতে বিদেশে তুলে দেওয়া হয়। আর দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করে, তারা তা হুন্ডি চক্রের হাতে তুলে দেয়।
হুন্ডি সমস্যা মোকাবিলায় সিআইডিকে খুঁজে বের করতে হবে, কারা এসব এমএফএস এজেন্টদের টাকা দিয়েছে। তাদের থামাতে পারলেই বন্ধ হবে হুন্ডি। তারাই মূলত অর্থ পাচারকারী। না হলে পাচার হওয়া টাকার পরিমাণ বছরে ৭৫ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ১ লাখ কোটিতে উঠেবে। পাচারও বন্ধ হবে না, হুন্ডিও চলবে।
১ বছরে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার ৭৫ হাজার কোটি টাকা :
অতি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি জানায়, বাংলাদেশ থেকে গত এক বছরে ৭৮০ কোটি ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকা হুন্ডি ব্যবসায়ীরা পাচার করেছেন। বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ‘ধারাবাহিক অনুসন্ধানে এমএফএস সেবা বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে হুন্ডি কারবারের সঙ্গে জড়িত ৫ হাজার বাংলাদেশি এজেন্টের তালিকা পাওয়া গেছে। ওই ৫ হাজার এজেন্ট গেল চার মাসে ২৫ হাজার কোটি ও গত এক বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন।’ এবং হুন্ডির বিষয়টি সামনে এসেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’
এআরআই