প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২২, ০৫:২১ এএম
‘আমার এ গল্পটা আপনাদের কাছে সিনাম্যাটিক মনে হলেও আসলে এটা সত্য। পৃথিবীটা খুবই সুন্দর, সবাই এখানে বেঁচে থাকতে চায়। কেউ চায়না তার অকাল মৃত্যু। আমার যদি আত্মহত্যা করে মৃত্যু বরণ করতে হয় তাহলে এর জন্য দায়ী থাকবেন আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুর আলম।’ কান্না বিজড়িত কণ্ঠে এমনটাই বলেছেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হওয়া গ্রাহক ছগীর হোসেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেখে এবং বন্ধুদের থেকে জেনে ছগীর বিনিয়োগ করেন আলেশা মার্টে। ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা করে ২টি একাউন্ট থেকে ৭টি বাজাজ পালসার ডাবল ডিস্ক মোটরসাইকেল অর্ডার দেন তিনি। বাইকগুলো বিক্রি করে মুনাফা লাভের আশায় এ বিনিয়োগ করেন তিনি। কিন্তু এই বিনিয়োগ যে তার গলার কাটা হয়ে দাঁড়াবে তা টের পাননি তিনি।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাসিন্দা ছগীর হোসেন। বর্তমানে থাকেন রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে একটি মেস বাসায়। তেজগাঁও সরকারি কলেজ থেকে করেছেন অনার্স ও মাস্টার্স। ঢাকায় আসার পর থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন বিভিন্ন কোচিং সেন্টার ও টিউশনির সঙ্গে। আর তাতেই সুন্দরভাবে চলছিল তার জীবন। কিন্তু ২০২০ সালে করোনার প্রকোপে বিঘ্নতা দেখা দেয় তার স্বাভাবিক জীবনে। বেকার হয়ে ধুঁকতে থাকেন হতাশায়। এক সময় পার হয়ে যায় সে বছর। ২০২১ এর এপ্রিল মাসে আলেশা মার্টের বিষয়টি তার নজরে আসে। এক বন্ধুর প্রলোভনে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। চিন্তা করেন, মাত্র ৪৫ দিনেরই তো ব্যাপার। এই কদিনের জন্য কিছু টাকা বিনিয়োগ করে যদি ভালো একটা মুনাফা পাওয়া যায় তাহলে কেনো নয়? এমন চিন্তা থেকেই বন্ধুর আইডি থেকে সে বছর মে মাসে ব্যাংক লোন, নিজের জমানো টাকা ও আত্মীয় স্বজন থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকার মত বিনিয়োগ করেন আলেশা মার্টে।
টাকা বিনিয়োগের ৪৫ দিন পর ডেলিভারির তারিখও পেয়েছেন তিনি। একবার নয়, তিনবার। কিন্তু একবারও পণ্য ডেলিভারি পাননি তিনি। এরপর বন্ধ হয়ে যায় আলেশা মার্টের কার্যক্রম। যদিও চেক পান তিনি। কিন্তু মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তখনই যখন ব্যাংকে গেলে চেক বাউন্স করে।
টাকা বিনিয়োগের ৪৫ দিন পর ডেলিভারির তারিখও পেয়েছেন তিনি। একবার নয়, তিনবার। কিন্তু একবারও পণ্য ডেলিভারি পাননি তিনি। এরপর বন্ধ হয়ে যায় আলেশা মার্টের কার্যক্রম। যদিও চেক পান তিনি। কিন্তু মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তখনই যখন ব্যাংকে গেলে চেক বাউন্স করে। চেক ডিজঅনার হলে আলেশা মার্ট প্রধানের বাড়ির সামনেও যান বেশ কয়েকবার। কিন্তু আশায় গুড়ে বালি। হয়নি তাতেও কোনো লাভ। এমনকি ভাড়া করা এলাকার মস্তান টাইপের কিছু মানুষের মাধ্যমে মঞ্জুরের বাড়ির সামনে থেকে তাকে তাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
বাধ্য হয়ে উকিল নোটিশ পাঠান মঞ্জুর আলম শিকদার ও সাদিয়া চৌধুরীর কাছে। তাতেও ফলপ্রসু কিছু হয়নি। এরপর মামলা করেন তাদের বিরুদ্ধে। আদালত থেকে জারি হয় গ্রেফতারি পরোয়ানাও। কিন্তু এখনো পর্যন্ত গ্রেফতার হননি অভিযুক্তদের কেউ।
এখন ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য প্রতিনিয়ত চাপে পড়ছেন তিনি। পেশাগত জীবনে এখন বেকার ছগীর। তাই পারছেন না সেগুলো শোধ করতে। এদিকে আলেশা মার্ট থেকেও নেই টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা। তাই অনেকটা দিশেহারা । আর এ কারণে হুমকি দিয়েছেন আত্মহত্যার। এমনকি তার আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু হলে মঞ্জুর আলম শিকদার ও সাদিয়া চৌধুরী দায়ী থাকবেন বলেও জানান তিনি।
১৫ দিনের মধ্যে একটি ব্যাংক ও বন্ধু-বান্ধবসহ প্রায় দশজন এর কাছ থেকে শর্ত সাপেক্ষে (লাভ অর্ধেক তাদের) কিছু টাকা ম্যানেজ করে পেমেন্ট করি বন্ধুর আইডি দিয়ে।’
আলেশা মার্টের প্রতারণার কারণে তার আত্মহত্যার হুমকি জনিত একটি পোস্টও দেখা যায় আলেশা মার্ট সংক্রান্ত বেশ কিছু ফেসবুক গ্রুপে। পোস্টে ছগীর লিখেন, করোনার সময় দিনটা তেমন ভালো কাটছিল না। হঠাৎ আমার এক বন্ধু বললো কারো কাছ থেকে যদি কিছু টাকা ম্যানেজ করতে পারো তাহলে আলেশা মার্টে ইনভেস্ট করতে পারো। এতে ভালো লাভ হবে। আমি করেছি, আমার আইডি দিয়ে করতে পারে। ১৫ দিনের মধ্যে একটি ব্যাংক ও বন্ধু-বান্ধবসহ প্রায় দশজন এর কাছ থেকে শর্ত সাপেক্ষে (লাভ অর্ধেক তাদের) কিছু টাকা ম্যানেজ করে পেমেন্ট করি বন্ধুর আইডি দিয়ে।’
তিনি আরও লিখেন, ‘আজ প্রায় দেড় বছর। যখন থেকে আলেশা মার্টে ইনভেস্ট করি, তখন থেকে আজ পর্যন্ত রাতে এক মিনিটের জন্য ঘুমাইতে পারি নাই। পারিনি এই ছন্নছাড়া জীবন নিয়ে বাড়িতে গিয়ে মা বাবার সাথে একটু সময় কাটাতে। পারিনা বাহিরে গিয়ে কার সাথে কথা বলতে। কারন পরিচিত সবাই আমার কাছে টাকা পায়। আবার কেউ অপমানও করে। মনে পড়ে না, লাস্ট কবে তিন বেলা খাবার খাইছি। এক দিকে যেমন বাহিরে বের হতে পারি না। অন্য দিকে ঘরের কোনে বসে হতাশা আর নিরাশায় ধুঁকে ধুঁকে মরছি।’
আমার বয়স এখন ৩০। এখনো না পারছি বিয়ে করতে, না পারছি একটা জব ম্যানেজ করতে। বরঞ্চ ১০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে হতাশায় বুক ফাটা কান্না নিয়ে ধুঁকে ধুকেঁ মরছি।’
ছগীর লিখেন, ‘আমার এ বুক ফাটা কান্না কেউ শুনছেনও না, দেখছেও না। প্রতিটা সেকেন্ড আমার কাছে মনে হয় অভিশপ্ত। আপনারা ভাবতে পারেন যে, আধুনিক যুগে তিন বেলা খেতে পারে না এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে নাকি। আছে কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। নিরবে সহ্য করে নিতে হয়। আমি যে কথা গুলো বলছি সবই সত্য। মিথ্যা বলে আমার দুর্বলতা প্রকাশ করে কোন লাভ নেই। আমার বয়স এখন ৩০। এখনো না পারছি বিয়ে করতে, না পারছি একটা জব ম্যানেজ করতে। বরঞ্চ ১০ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে হতাশায় বুক ফাটা কান্না নিয়ে ধুঁকে ধুকেঁ মরছি।’
এভাবে মরার চেয়ে আত্মহত্যা অনেক শ্রেয়। আমার রঙিন জীবনটা নষ্ট করে দিল শিকদারের মত জানোয়ারের বাচ্চারা, তারা আমাকে বাঁচাতে দিবে না।
তিনি লিখেন, ‘এভাবে মরার চেয়ে আত্মহত্যা অনেক শ্রেয়। আমার রঙিন জীবনটা নষ্ট করে দিল শিকদারের মত জানোয়ারের বাচ্চারা, তারা আমাকে বাঁচাতে দিবে না। তাই কোন পাঠক কিংবা সাংবাদিক ভাইয়েরা আমার জীবনের শেষ সময়ে লেখাটা যদি পড়েন তাহলে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
তিনি আরও লিখেন, ‘জানি আপনারা আমার এ লেখাটা আলেশা মার্ট এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা মিডিয়ার নজরে আনতে পারবেন না। তবে আমার যদি আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু হয়েই য়ায় তাহলে দয়া করে আপনারা দুইটাই কাজ করবেন।
প্রথমত, আপনারা শিকদার ও তার স্ত্রীকে ছাড়বেন না। তারা যেন এক দিনের জন্য হলেও জেলে যায়। তাহলে তারা বুঝবে খাবারের কী কষ্ট, ৩০ বছর বয়সি একজন যুবকের ঋণের কী কষ্ট, মাসের পর মাস ঘরে বন্দী থাকার কি কষ্ট। আমি শিকদার ও তার স্ত্রীর নামে মামলা ও ওয়ারেন্ট হওয়া সব ডকুমেন্ট রেখে যাব যাতে আমার মৃত্যুর মাধ্যমে আপনারা বাকিরা টাকা ফেরত পান।
আপনারা আমাকে আমার গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। কারণ আমার জীবনে কোন এক্সিডেন্ট ঘটলে পরিবারের সামর্থ্য নেই ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়ার। আমার স্থায়ী ঠিকানা উপরে দেয়া আছে। জীবনে সৎ হয়ে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন।
দ্বিতীয়ত, আপনারা আমাকে আমার গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। কারণ আমার জীবনে কোন এক্সিডেন্ট ঘটলে পরিবারের সামর্থ্য নেই ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়ার। আমার স্থায়ী ঠিকানা উপরে দেয়া আছে। জীবনে সৎ হয়ে বেঁচে থাকা খুবই কঠিন।’
ছগীর হোসেনের এই মর্মাহত পোস্টটি চোখে পড়ে সিটি নিউজ ঢাকার। পরবর্তীতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎ করলে তিনি আলেশা মার্টের প্রতারণার বিষয়গুলো তুলে ধরেন। ছগীর বলেন, ‘মঞ্জুর আলম অসংখ্যবার ফেসবুক লাইভে এসেছেন। তিনি বারবার মানুষকে টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তার বাস্তব কিছুই ঘটেনি। তিনি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সময়ক্ষেপন করছেন। মঞ্জুর আলম লিস্ট দিচ্ছেন, আমার মনে হয় না এই লিস্টের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আছে। কেননা লিস্ট দিলে আমারটাও থাকতো। এমনকি অনেক গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলেছি তাদেরটাও নেই। এগুলো সবই মিথ্যা।’
তিনি বলেন, ‘মঞ্জুর আলম শিকদার আলেশা মার্টের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার একটি ফাঁদ পেতেছিলেন। সেই ফাঁদে পা দিয়ে আজকে আমার আত্মহত্যা করার মত অবস্থা। আমার মত আরও অনেকেই আছেন।’
ছগীর আরও বলেন, ‘আমি মামলা করেছি। ওয়ারেন্টও বের হয়েছে। কিন্তু তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। এতে আমার হতাশার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি চাই, মঞ্জুর আলমকে আইনের আওতায় আনা হোক। আমার টাকাগুলো ফেরত দেয়া হোক। যাতে আমি ঋণমুক্ত হতে পারি এবং আত্মহত্যার মত ঘৃণ্য পথে যেতে না হয়। যদি তেমন কিছুই হয়ে যায় আমার সঙ্গে তাহলে এর জন্য দায়ী থাকবেন মঞ্জুর আলম শিকদার ও তার স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরী।’
‘আমরা ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করবো এবং তাকে কিভাবে আত্মহত্যা থেকে বিরত করা যায়- সে ব্যবস্থা নিবো।’ - ওসি কাফরুল থানা
তার আত্মহত্যার হুমকির বিষয়টি উদ্ধেগজনক মনে হলে এই প্রতিবেদক ছগীরের তথ্যসহ বিষয়টি স্থানীয় কাফরুল থানাকে অবহিত করেন। এ বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আত্মহত্যার হুমকি দেয়াটা উদ্ধেগজনক। যেহেতু বিষয়টার সঙ্গে আলেশা মার্ট ইস্যু রয়েছে সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয়টা হবে - তাকে মোটিভেট করা এবং তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মহত্যা থেকে বিরত রাখা যায় তা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, ‘ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করবো এবং তাকে কিভাবে আত্মহত্যা থেকে বিরত করা যায়- সে ব্যবস্থা নিবো।’
এআরআই