প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২২, ১১:১৩ পিএম
বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ গ্রাহকরা। তারা মনে করছেন, সুচতুর আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুর আলম শিকদার কোনোভাবে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে থাকতেও পারেন। না হলে এত দিনেও সরকারি সংস্থাগুলো আলেশা মার্ট প্রধান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় ব্যাপক আলোচনা ও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
চলতি বছরের মে মাসে আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রীর সম্পদের হিসাব তলব করে চিঠি দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সেখানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার কথা উল্লেখ করে এই তদন্ত সংস্থাটি। এ বিষয়ে আলেশা মার্ট চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদও করে সিআইডি।
তবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে কী তথ্য পাওয়া গেছে সে বিষয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত মুখ খোলেনি তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। মঞ্জুর আলম ও তার স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে হয়নি অর্থ পাচারের কোনো মামলাও। আলেশা মার্ট প্রধানকে জিজ্ঞাসাবাদে কী কী তথ্য পেয়েছিল এই তদন্ত সংস্থা এ বিষয় নিয়ে অপরাধ সংশ্লিষ্ট ও গ্রাহকদের মাঝে চলছে জোর আলোচনা। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা না হওয়ায় দেখা দিচ্ছে সন্দেহ।
তার কাছে যদি গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের টাকা না থাকে তাহলে এই শত শত কোটি টাকা গেল কই? নিশ্চয়ই তিনি মিথ্যা বলছেন, নাহলে এই টাকাগুলো বিদেশে পাচার করেছেন। এখন শুধু অপেক্ষা করছেন নিজে পালাবার
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিআইডি যেহেতু মানি লন্ডারিংয়ের প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে; সে ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তারা যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সেটা করেছে। তা না হলে অনুমাননির্ভর হয়ে কোনো সরকারি সংস্থা এ ধরনের চিঠি ইস্যু করবে না। কারণ, তদন্ত সংস্থার লোকজন অত্যন্ত চৌকষ ও মেধাবী। তারা সব ধরনের আটঘাট বেঁধে মানি লন্ডারিংয়ের যথেষ্ট তথ্য পেয়েই চিঠি দিয়েছিল আলেশা মার্ট প্রধানকে। কিন্তু তারপর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও বিষয়টির কোনো সুরাহা না হওয়ায় গ্রাহকদের মাঝে নানা সন্দেহ দানা বেঁধেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গ্রাহক বলেন, ‘শিকদার গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে শত শত কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। এখন আবার গ্রাহকদের টাকা পরিশোধের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে টাকা চেয়েছিলেন, ব্যাংক ঋণের নাটক করছেন। তার কাছে যদি গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের টাকা না থাকে তাহলে এই শত শত কোটি টাকা গেল কই? নিশ্চয়ই তিনি মিথ্যা বলছেন, নাহলে এই টাকাগুলো বিদেশে পাচার করেছেন। এখন শুধু অপেক্ষা করছেন নিজে পালাবার।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমাদের একটাই দাবি। মঞ্জুর আলমকে গ্রেফতার করা হোক। তাকে আইনের আওতায় এনে আমাদের টাকা ফেরত দেয়া হোক।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে ব্যক্তি লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে হাজার হাজার মানুষের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে পারে তিনি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ধুরন্ধর ও চতুর প্রকৃতির। তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অবশ্যই ব্যাংকে রাখার ঝুঁকি নেবেন না। তিনি এই টাকা ক্যাশ করে কোথাও লুকিয়ে রাখবেন অথবা বিদেশে পাচার করবেন।
তারা বলছেন, এটা অনুধাবন করা খুবই সহজ একটা বিষয়। কারণ, তিনি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ই-কমার্স ব্যবসায় আসেননি- সেটা আগেই প্রমাণিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের নিরবতা অন্য কিছুর ইঙ্গিত করে।
জানতে চাইলে অপরাধ বিশেষজ্ঞ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যপাক মো. আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, ‘কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত থাকার পরও আইনি পদক্ষেপ না নেয়া এক ধরনের অপরাধ। যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে তাহলে অভিযুক্ত বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশের বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমি বলবো, তথ্য-উপাত্ত ও প্রমাণগুলো তদন্ত কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন কাউকে অবহিত করা, তাহলে তিনি ব্যবস্থা করবেন। যদি তাতেও কোনো আশানুরুপ ফল না পাওয়া যায় তাহলে আদালতে উপস্থাপন করতে হবে। এবং আদালত থেকে রুল জারি করতে হবে। এরপরও যদি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা দেখা তাহলে গণমাধ্যমের শরণাপন্ন হতে হবে।’
অনেকেই মনে করছেন, তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চিঠি ইস্যুর আগেই ভালোভাবে তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করেছেন। যদি তেমনটা না হতো তাহলে চিঠিতে মানি লন্ডারিংয়ে যুক্ত থাকার প্রাথমিক তথ্যের কথা উল্লেখ করত না সিআইডি। প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার মানে এই দাঁড়ায় যে, তথ্য আছে- সেই তথ্য আরও জোড়ালো হবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে। কোনো সংস্থার কাছেই প্রাথমিকভাবে সব তথ্য থাকে না। পরিপূর্ণ তথ্য তখনই আসে যখন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
আলেশা মার্ট প্রধানকে কী কেউ কেউ আড়ালে রাখতে সহায়তা করছেন? তা না হলে এত গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও কেন তাকে ধরা হচ্ছে না?
আবার কেউ স্বীকার করতে না চাইলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের নানা কৌশল আছে। আর সিআইডি এতটাই দক্ষ যে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের কৌশলের কাছে যে কোনো অপরাধীকে তথ্য স্বীকার করতেই হয়। অন্তত কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিই সব খুলে না বললেও কিছুটা বলবেই। তাছাড়া আলেশা মার্টের ক্ষেত্রে অনেক ‘ইলেক্ট্রনিক অ্যাভিডেন্স’ রয়েছে। এসব কিছু বিবেচনায় ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
যে কারণে আলেশা মার্ট প্রধানের ব্যাপারে সিআইডির ভূমিকা নিয়ে সাধারণ গ্রাহকরা প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, আলেশা মার্ট প্রধানকে কী কেউ কেউ আড়ালে রাখতে সহায়তা করছেন? তা না হলে এত গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও কেন তাকে ধরা হচ্ছে না?
মঞ্জুর আলমকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে প্রতারিত গ্রাহকদের পাওনা ফেরতের দাবি জানিয়েছেন আলেশা মার্টের নিঃস্বপ্রায় গ্রাহকরা।
এআরআই