• ঢাকা শুক্রবার
    ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মঞ্জুর আলমকে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ, সতর্ক রুপালী ব্যাংক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২২, ০৩:২৭ এএম

মঞ্জুর আলমকে বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ, সতর্ক রুপালী ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

ই-কমার্স ব্যবসার নামে জালিয়াতি, হয়রানি ও প্রতারণা করে গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা মেরে দেয়ার অসংখ্য অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। মাথার উপর ঝুলছে শতাধিক গ্রেফতারি পরোয়ানা। সব দিক ম্যানেজ করে একের পর এক পেতে যাচ্ছেন প্রতারণার ফাঁদ। তিনি আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম শিকদার।

আলেশা মার্ট গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে এখন ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। চাচ্ছেন মোটা দাগের ঋণ। তবে আলেশা মার্টের অনুকূলে ঋণ চাচ্ছেন না মঞ্জুর আলম, চাচ্ছেন আলেশা ব্যাগস নামক এক প্রতিষ্ঠানের নামে। সেটারও মালিক তিনি। রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকে এই ঋণের আবেদন করেছেন মঞ্জুর আলম।

আলেশা ব্যাগস -এর আবেদনে জানা যায়, কৃত্রিম চামড়া, চামড়াজাত, কাপড়ের ব্যাগ এবং লাগেজ তৈরির প্রকল্প স্থাপনের জন্য ঋণ চায় প্রতিষ্ঠানটি। আবেদনে উল্লেখ করা হয়-

(ক) প্রকল্পের মোট স্থায়ী ব্যয় ৫৪.৬২ কোটি টাকার মধ্যে ৬০:৪০ রেশিওতে ৮ বছর মেয়াদে (নির্মাণকালীন সময় ১ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ৬ মাস বাদে) প্রকল্প মেয়াদী ঋণ ৩২.৯২ কোটি (মেয়াদী ৩১.৫০ কোটি + আইডিসিপি ১.৪২ কোটি) টাকা; (খ) চলতি মূলধন ঋণ সীমা (সিসি হাইপো) ৪.৫০ কোটি; (গ) ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র সীমা ৩১.০০ কোটি টাকা; এবং (ঘ) পিসি (পেকিং ক্রেডিট) ৪.৫০ কোটি টাকা।

কিন্তু ইতোমধ্যে আলেশা মার্টের প্রতারণায় তার ট্রাক রিপোর্ট শূন্যে নেমে এসেছে। বাজারে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছেন তিনি। ফলে তাকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবছে রূপালী ব্যাংকের শিল্পঋণ বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান ভিন্ন হলেও ব্যক্তি তো একজনই। এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকখাত সর্বদা সতর্ক। তারপরও যদি কোনো ব্যাংক এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করে তাহলে সেটা হবে চরম ঝুঁকিপূর্ণ। শুধু তাই নয়, সেখানে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও লেনদেন থাকাটাও অসামঞ্জস্য নয়।’ তবে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করার আহ্বান জানান তিনি।

আলেশা মার্ট বা আলেশা ব্যাগস লিমিটেড উভয় প্রতিষ্ঠানের মালিক একই ব্যক্তি। আর সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নেতিবাচক রিপোর্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণদানের ক্ষেত্রে ট্রাক রিপোর্ট ভালো থাকা বাঞ্ছনীয়। 

রূপালী ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, আলেশা মার্ট বা আলেশা ব্যাগস লিমিটেড উভয় প্রতিষ্ঠানের মালিক একই ব্যক্তি। আর সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নেতিবাচক রিপোর্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণদানের ক্ষেত্রে ট্রাক রিপোর্ট ভালো থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আলেশা মার্ট বা আলেশা ব্যাগস মালিকের নামে থাকা বিভিন্ন অভিযোগ লাগাতার যেভাবে গণমাধ্যমে প্রচার চলছে তা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পর্যন্ত পৌঁছেছে।

জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান মালিকের এমন ট্রাক রিপোর্ট জেনে তাকে ঋণ দেয়া কোনো ব্যাংকের উচিত হবে না। এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে সে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। ব্যাংকের পক্ষ থেকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ না করাই হবে উত্তম।’

রূপালী ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘জেনেশুনে এমন কোনো ব্যক্তিকে ঋণ দেবে না ব্যাংক। যার বিরুদ্ধে বাজারে ব্যাপক নেতিবাচক কথাবার্তা ও সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। তাই আলেশা ব্যাগসকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে বার বার ভাবছে ব্যাংক।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এই ব্যক্তির ক্যারিয়ার ও আর্থিক লেনদেন সম্পর্কে মানুষ জেনে গেছে তিনি ব্যবসার নামে লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা মোকাদ্দমা আছে। ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। এসব জানা সত্ত্বেও তাকে যদি ঋণ দেয়া হয় তা হলে বুঝতে হবে এখানে ঋণ দিয়ে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সমালোচিত ব্যক্তির কাছ থেকে ফায়দা নিতে চাচ্ছেন।’

জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী সানাউল হক বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির চাপ বাংলাদেশের অর্থিক খাতেও পড়েছে। বর্তমান ঋণদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করছে ব্যাংকগুলো। রূপালী ব্যাংক এর বাইরে নয়। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান মালিকের ট্রাক রিপোর্ট আমাদের নজরে এসেছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রুপালী ব্যাংকের সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠানের নাম বলা হচ্ছে, বাজারে তার ব্যাপারে সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গ্রাহক হয়রানি ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছেন গ্রাহকরা। আমি মনে করি, কোনো ব্যাংক এ ধরনের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেবে না। যদি কেউ ঋণ দেয় তাহলে সে বিনিয়োগ ঝুঁকিতে থাকবে।’

রূপালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কাছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত নেতিবাচক খবরগুলো পৌঁছেছে জানিয়ে ব্যাংকের মনিটরিং বিভাগের অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রাহক মঞ্জুর আলম শিকদারের ট্রাক রিপোর্ট নিয়ে অর্থনীতিবিদরা যেসব মন্তব্য করেছেন। এসব নজরে এসেছে ব্যাংকের। এই ব্যক্তিকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা আছে।’

ওই কর্মকর্তার মতে, ব্যাংক তখনই কাউকে সহজে ঋণ দেবে যখন তার ট্রাক রিপোর্ট ভালো থাকবে। কিন্তু যার সম্পর্কে বাজারে এবং গণমাধ্যমে হৈচৈ উঠে গেছে তার সম্পর্কে ব্যাংক এখন বার বার ভাববে।

রুপালী ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘এক সময় ব্যাংক ঋণ দেয়ার জন্য বসে থাকতো। ট্রাক রিপোর্ট ও নীতিমালা সব মিলে গেলে ঋণ দিতে কোনো বাধা থাকে না। কিন্তু বর্তমানে যে ব্যক্তির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে তার বিষয়ে ব্যাংক ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে। প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যে দেখা গেছে- তিনি সামাজিকভাবে যেমন সমালোচিত তেমনি অসংখ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে ঘুরছেন।’

 ‘ই-কমার্সের নামে গ্রাহকের অর্থ লোপাট করে যে ব্যক্তি ব্যবসায়ীক সুনাম নষ্ট করেছেন তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’

আলেশা মার্টের প্রতারণা সম্পর্কিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালনা পর্ষদ পর্যন্ত পৌঁছেছে জানিয়ে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ই-কমার্সের নামে গ্রাহকের অর্থ লোপাট করে যে ব্যক্তি ব্যবসায়ীক সুনাম নষ্ট করেছেন তার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’

বিভিন্ন অভিযোগ ও ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুর আলমের সঙ্গে প্রতিনিয়তই যোগাযোগের চেষ্টা করছে সিটি নিউজ ঢাকা। কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছেন না তিনি। এমনকি তাকে এসএমএস বার্তা পাঠানো হলেও তার উত্তর মেলেনি।

এআরআই/এএল

আর্কাইভ