প্রকাশিত: অক্টোবর ১৬, ২০২২, ১১:০৬ পিএম
অন্যের সুখের বাতি নিভিয়ে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে গড়েছেন সুখের সংসার। সেই সংসার গড়তে গিয়ে তারা তছনছ করে দিয়েছেন অনেক দম্পতির সংসার। তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করতে নিঃস্ব করেছেন অসংখ্য মানুষকে। সেরকমই এক দম্পতি মঞ্জুর আলম শিকদার ও সাদিয়া চৌধুরী। তারা চতুরতায় ভর করে চালু করেছেন আলেশা মার্ট। নামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হলেও এটা ছিল মূলত মানুষের পকেট কাটার মেশিন। এখন এমনটাই অভিযোগ করেন গ্রাহকরা।
তারা ই-কমার্সের সুবিধার টোপ দিয়ে অনেককে ফতুর করে দিয়েছেন। খাবলে খেয়েছেন সাধারণ মানুষের সঞ্চিত সম্পদ। তাদের হাতে ই-কমার্স নিরাপদ নয়। তাদের লোভ এবং ব্যক্তি স্বার্থ মানুষকে দেউলিয়া করেছে। এখানেই শেষ নয়, সব কিছু কেড়ে নিয়ে অনেককে ঠেলে দিয়েছেন মৃত্যুর দিকে।
তাদের ফাঁদে পা রেখে মানুষ সর্বশান্ত হয়েছে। একইসঙ্গে তারা ই-কমার্স খাঁতকে পঙ্গু করেছেন। ভুক্তভোগী মানুষগুলো কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়েছে। পথে পথে ঘুরে বিলাপ করছেন ভুক্তভোগীরা। বিভ্রান্তের মত হয়ে গেছেন অনেকে। অসহনীয় যন্ত্রণা ওই সব নিঃস্ব মানুষ বয়ে বেড়াতে না পেরে অনেকেই বিষ খেয়ে, কেউ আবার গায়ে আগুন দিয়ে মরতে চেয়ে হুমকি দিয়েছেন সামাজিক মাধ্যমে।
‘আর কত অপেক্ষা! ১০ মাস পার হয়ে গেল এখনও টাকা ফেরত পাবার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নাই। নিজের সব সম্বল আলেশা মার্টে বিনিয়োগ করেছি। এখন এই টাকা না পেলে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যা করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’
ফেসবুক ভিত্তিক ‘আলেশা মার্ট কাস্টমার এসোসিয়েশন’ নামক একটি গ্রুপে আত্মহত্যার হুমকি দেয়া বেশ কয়েকটি পোস্ট দেখা গেছে। এক গ্রাহক সেখানে লিখেছেন, ‘আর কত অপেক্ষা! ১০ মাস পার হয়ে গেল এখনও টাকা ফেরত পাবার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নাই। নিজের সব সম্বল আলেশা মার্টে বিনিয়োগ করেছি। এখন এই টাকা না পেলে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যা করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।’
মঞ্জুর আলম শিকদার ও আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ভূমিকা পালনে হতাশা প্রকাশ করেছেন শ্যামল কুমার দাস নামক আরেক গ্রাহক। তিনি লেখেন, ‘যে দিন গাজী আনিস সাহেবের মতো গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আলেশা মার্ট এর কোনো গ্রাহক আত্মাহুতি দেবে সে দিনই প্রশাসনের টনক নড়বে।’
তবে প্রতারিত গ্রাহকদের দাবি, এই লুটেরাদের এখনই আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদেরকে উচিত জবাব দিতে হবে যে, মানুষ ঠকালে কী পরিণতি হয়। ভুক্তভোগীরা জানান, ইভ্যালির রাসেল-শামীমা দম্পতিকে জেলে পাঠানো হলেও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মঞ্জুর-সাদিয়া দম্পতি। তাই এবার আইনের আওতায় আনা হোক মঞ্জুর আলম ও তার স্ত্রী সাদিয়াকে। তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে থানায় থানায়। তবুও অধরা তারা। যেনো আইনের ডগায় নির্ভয় চিত্তে বসে আছেন এ দুজন।
ই-কমার্স খাতের সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, মঞ্জুর আলম শিকদার ও সাদিয়া চৌধুরী দম্পতি গতবছর জানুয়ারিতে চালু করেন আলেশা মার্ট। যেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদে আসীন করেন মঞ্জুর আলম। আর স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরীকে বসান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আসনে। কিন্তু এই আসনগুলোর আড়ালে থেকে ফন্দি করেছিলেন কীভাবে মানুষকে ঠকানো যায়। ভারী করা যায় নিজেদের সম্পদের পাল্লা। আর যেই পরিকল্পনা, সেই কাজ। লোভনীয় অফার দিয়ে আকৃষ্ট করতে থাকেন দেশের সাধারণ মানুষকে। বিভিন্ন পণ্যে দিয়েছেন আকর্ষণীয় ছাড়। তা দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল গ্রাহকেরা। বিনিয়োগ করতে থাকে আলেশা মার্টে।
আলেশা মার্ট চালু থাকাকালীন বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা যেতো তাকে। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন একটি ম্যাগাজিনে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘এই ধরণের ব্যবসার ক্ষেত্রে কাস্টমারদের বিশ্বস্ততা অর্জন সবচেয়ে জরুরী’। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, টাকা হাতিয়ে নেয়ার পেছনে গ্রাহকদের বিশ্বস্ততা অর্জন করা কী ছিল পূঁজি?
মঞ্জুর আলম দম্পতির ছিলো বড় পরিকল্পনা। অল্পতেই তো আর নিজেদের পকেট পুরবে না। বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার আগে প্রয়োজন আরো বেশি বিনিয়োগ। তাইতো পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে প্রথম দিকে দিয়েছেন পণ্য ডেলিভারি। যাতে গ্রাহকরা বিশ্বাস করেন তাদের। আর বিনিয়োগ করেন আরও বিশাল আকারের। লোভনীয় অফারের আড়ালে এই দম্পতির ফাঁদ বুঝতে পারেনি সাধারণ মানুষেরা। বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করেন নিজেদের সর্বস্ব। আর এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল এই লুটেরা দম্পতি। হাতিয়ে নিয়েছেন গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা।
আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুরুল আলম যদিও লাইভে দাবী করেছিলেন পণ্য ডেলিভারি নিয়ে সমস্যা শুরু হওয়ার পূর্বে তিনি সম্মুখে আসেননি। সমস্যা পরবর্তী সময়ে তিনি ৩৫ বার আসেন লাইভে।
এদিকে আবার ব্যতিক্রম তার স্ত্রী সাদিয়া চৌধুরী। আলেশা মার্ট নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে দেখা যায়নি তাকে। বলা চলে অনেকটা আত্মগোপনেই রয়েছেন তিনি। তবে আলেশা মার্ট চালু থাকাকালীন বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা যেতো তাকে। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন একটি ম্যাগাজিনে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘এই ধরণের ব্যবসার ক্ষেত্রে কাস্টমারদের বিশ্বস্ততা অর্জন সবচেয়ে জরুরী’। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, টাকা হাতিয়ে নেয়ার পেছনে গ্রাহকদের বিশ্বস্ততা অর্জন করা কী ছিল পূঁজি?
এই বিশ্বস্তার ফাঁদে পড়ে বিনিয়োগের টাকা হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন গ্রাহকেরা। হন্যে হয়ে খুঁজছেন টাকা ফেরত পাবার উপায়। অভিযোগ করেছেন তারা দেশের বিভিন্ন আদালতে। তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে অধরাই রয়েছেন ওই দম্পতি। কিন্তু কী কারণে এখনো বহাল তবিয়তে তা জানা নেই কারো। গ্রাহকদের দাবী তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।
সাদিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের করা অসংখ্য মামলায় ওয়ারেন্ট হয়েছে। সিটি নিউজ ঢাকার নিকট বেশ কিছু ওয়ারেন্টের তথ্য রয়েছে।
তাকে ফোনকল দেয়া হলে তিনি রিসিভ করে হ্যালো বলেছিলেন। এরপর সিটি নিউজ ঢাকার পরিচয় শুনে কলটি কেটে দেন। তারপর একাধিকবার কল করেও আর কোন সাড়া মেলেনি। এরপর ওই নাম্বারে এসএমএস দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে আলেশা মার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া চৌধুরীর বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হয়। তাকে ফোনকল দেয়া হলে তিনি রিসিভ করে হ্যালো বলেছিলেন। এরপর সিটি নিউজ ঢাকার পরিচয় শুনে কলটি কেটে দেন। তারপর একাধিকবার কল করেও আর কোন সাড়া মেলেনি। এরপর ওই নাম্বারে এসএমএস দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
এসব বিষয়ে আলেশা মার্ট প্রধান মঞ্জুর আলম শিকদারের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছে সিটি নিউজ ঢাকা। প্রথম দফায় তিনি সিটি নিউজ ঢাকার সঙ্গে এসএমএস বার্তার মাধ্যমে উত্তর দিলেও পরে আর কোনো কথা বলেননি। তার কাছ থেকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে এসএমএস বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর আসেনি।
মঞ্জুর আলম শিকদার ও সাদিয়া চৌধুরীর মত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আড়ালে ফাঁদ পেতেছিলেন আরেক দম্পতি মোহাম্মদ রাসেল ও শামীমা নাসরিন। চালু করেছেন ইভ্যালি নামক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। সেখানেও ই-কমার্সের নামে হাতিয়ে নিয়েছেন মানুষের টাকা। প্রমানও হয়েছিল সে অভিযোগ। এর দায়ে অবশ্য গ্রেফতার হয়েছেন ওই দম্পতি। জেলও খেটেছেন কয়েকমাস। শামীমা নাসরিন জামিনে মুক্ত হলেও এখনো কারাগারে রয়েছেন রাসেল।
এমনকি আদালতের নির্দেশে ইভ্যালির জন্য গঠন করা হয়েছিল নতুন পরিচালনা পর্ষদ। সম্প্রতি শামীমা নাসরিনের হাত ধরে আবার পথ চলা শুরু করেছে ইভ্যালি।
গ্রেফতারের আগে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছিলাম আমাদের দেনা আনুমানিক ৪০০ কোটি টাকা। সেজন্য ছয় মাস সময় চেয়েছিলাম। আমরা সেই সময় পাইনি। -শামীমা নাসরিন
ইভ্যালির ফেরা নিয়ে সম্প্রতি প্রেস কনফারেন্স করেছেন শামীমা নাসরিন।
সেখানে নাসরিন বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের যতগুলো মামলা হয়েছে, সেগুলো খুবই সামান্য। প্রায় ২০ কোটি টাকা পাওনার মামলা হয়েছে। মো. রাসেল যেসব মামলায় আটক রয়েছেন, সেগুলো সর্বমোট দেড় কোটি টাকার মামলা। গ্রেফতারের আগে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছিলাম আমাদের দেনা আনুমানিক ৪০০ কোটি টাকা। সেজন্য ছয় মাস সময় চেয়েছিলাম। আমরা সেই সময় পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা মূলত গ্রাহকের পাওনা পরিশোধে বিলম্ব হওয়ার অভিযোগ এবং চেক ডিজঅনার সম্পর্কিত। যারা মামলা করেছেন শুধু তাদেরই অর্থ ফেরত দেওয়া নয়, আমরা চাই সবার অর্থই ফেরত দিতে। আমরা যেহেতু বিজনেস করার সুযোগ পেয়েছি, মহামান্য আদালত লাখ-লাখ গ্রাহক এবং বিক্রেতার স্বার্থে শিগগিরই মো. রাসেলকে জামিন দেবেন বলে আমরা আশা করি। আমরা যে কোনো শর্তে জামিন প্রার্থনা করব’।
আমাদের পরিচালনায় হাইকোর্ট থেকে নিয়োজিত দুজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর নিয়োজিত আছেন। মাহবুব কবির মিলন (সাবেক অতিরিক্ত সচিব) স্যারও আমাদের সবসময় গাইড করছেন। আমাদের যেন কোনো ভুল না হয়, সে বিষয়ে তিনি আমাদের সতর্ক করে যাচ্ছেন। - শামীমা নাসরিন
গ্রাহকদের আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে ইভ্যালির সহ-প্রতিষ্ঠাতা শামীমা নাসরিন বলেন, ‘আমাদের পরিচালনায় হাইকোর্ট থেকে নিয়োজিত দুজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর নিয়োজিত আছেন। মাহবুব কবির মিলন (সাবেক অতিরিক্ত সচিব) স্যারও আমাদের সবসময় গাইড করছেন। আমাদের যেন কোনো ভুল না হয়, সে বিষয়ে তিনি আমাদের সতর্ক করে যাচ্ছেন।’
আলেশা মার্টের প্রতরণা নিয়ে গ্রাহকদের দাবি, রাসেল দম্পতিকে যেভাবে আইনের আওতায় নেয়া হয়েছে ঠিক সেভাবেই আইনের আওতায় নেয়া হোক মঞ্জুর আলম শিকদার ও সাদিয়া চৌধুরী দম্পতিকে । আর ফিরিয়ে দেয়া হোক ভুক্তভোগীদের বিনিয়োগের টাকা। একইভাবে আর কোনো দম্পতি যেনো ফন্দি করে মানুষের ভালো থাকার উপায় কেড়ে নিতে না পারে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে এই দাবী জানান তারা।
এআরআই