• ঢাকা শুক্রবার
    ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
আলেশা মার্ট প্রধানের সঙ্গে কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক

‘যত টাকা ঘুষ দিয়েছি তা দিয়ে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করা যেতো’

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২, ০৮:১৭ পিএম

‘যত টাকা ঘুষ দিয়েছি তা দিয়ে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করা যেতো’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

তদন্তকারীদের এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ টাকা ঘুষ দিয়েছেন তা দিয়ে প্রতারিত গ্রাহকদের প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করা যেতো- এমন দাবি করেছেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম শিকদার। ফলশ্রুতিতে এখন তিনি সস্ত্রীক দেশ ত্যাগের পরিকল্পনাও করছেন।

বিষয়টি নিয়ে অতিসম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করেছেন তিনি। রাজধানীর অভিজাত এক এলাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলেশা মার্ট নিয়ে নানা রকম হতাশার কথা জানান মঞ্জুরুল আলম।

‘তদন্তের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই চাচ্ছেন আমি দেশে থেকে এভাবেই তাদের মাসোহারা দিয়ে যাই। কিন্তু অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে আমার দেশে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে।’ - মঞ্জুরুল আলম শিকদার, চেয়ারম্যান, আলেশা মার্ট

 

আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান বৈঠকে জানান, তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ঘুষ দিতে দিতে তিনি পেরেশান হয়ে পড়েছেন। প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বিভিন্ন হাত ঘুরিয়ে এই ঘুষের টাকা নিচ্ছেন।

ফলে আলেশা মার্ট আর ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় নেই বলেও উপস্থিত কর্মকর্তাদের জানান তিনি।

মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘তদন্তের সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই চাচ্ছেন আমি দেশে থেকে এভাবেই তাদের মাসোহারা দিয়ে যাই। কিন্তু অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে আমার দেশে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে উপস্থিত আলেশা মার্টের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সিটি নিউজ ঢাকা’কে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

ই-কমার্স সেক্টরকে উদীয়মান অর্থনীতির বৃহৎ চালিকাশক্তি বলা হলেও নানান কূট-কৌশলে একের পর এক প্রতারণা করে যাচ্ছে আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম শিকদার। তার প্রতারণার জালে আটকা পড়ে হাজার হাজার পরিবার আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে।

বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে মানুষের কেনাকাটার জন্য প্রথম পছন্দ ই-কমার্স প্লাটফর্ম। ডিজিটাল প্রতারণার গণ্ডি পেরিয়ে ধীরে ধীরে দেশের আধুনিক জনগোষ্ঠির আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো এই খাতটি। ঠিক এমন সময় আবির্ভাব ঘটে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টের।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে চটকদার ও লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর কিছু পণ্যের ডেলিভারি দিয়ে জিতে নেয় গ্রাহকদের আস্থা। তারপর বের হয়ে আসে প্রতিষ্ঠান প্রধান মঞ্জুরুল আলম শিকদারের আসল রূপ। শুরু হয় প্রতারণা।

আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলমের পরিকল্পনায় গ্রাহকদের কাছ থেকে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় শত শত কোটি টাকা। বন্ধ করা হয় পণ্য সরবরাহ। ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর বন্ধ করা হয় দাপ্তরিক কার্যক্রম।

 

বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন প্রতারিত গ্রাহকরা। শুরু হয় আন্দোলন। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে আলেশা মার্টের প্রধান কার্যালয়ে সাত ঘণ্টা আটকে রাখা হয় আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলমকে। দীর্ঘ সময় আটকে রাখায় অসুস্থ হয়ে পড়েন মঞ্জুরুল আলম শিকদার। পরে রাত ৯টার দিকে বনানী থানা-পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।

রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হতে থাকে একের পর এক অভিযোগ। নড়েচড়ে বসে প্রশাসনসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতারণার অভিযোগে শুরু হয় তদন্ত। তদন্তে উঠে আসে বিভিন্ন ব্যাংকে আলেশা মার্টের ৫৬টি হিসাব রয়েছে। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত আলেশা মার্টের ওই হিসাবগুলোতে গ্রাহকেরা প্রায় ২ হাজার ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা জমা করেছেন। এর মধ্যে আলেশা মার্ট ১ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে।

এরপর শুরু হয় প্রতারণার উপর প্রতারণা! প্রতারিত গ্রাহকদের পাওনা অর্থ ফেরতের নাম করে নিজেদের লোকদের দিয়ে অর্থ প্রাপ্তির কথা বলে দেয়া হয় ফেসবুক পোস্ট। যেখানে দেখা যায় একই নাম্বারের টাকা এবং বান্ডিল দেয়া হয়েছে একাধিক জনকে। এ ছাড়া টাকা প্রাপ্তির পোস্ট দেয়া অধিকাংশ আইডিই ফেক বলেও প্রমাণিত হয়।

শুধু তাই নয়, আলেশা মার্ট অভিনব কায়দায় ক্রেতার তথ্য সংগ্রহ করে মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে। আলেশা মার্টের চেয়ারম্যানের বহু তথ্য এখনও অজানা থেকে গেছে। একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা তার ব্যাপারে যে ধরনের তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে যা পিলে চমকানোর মতো। হয়তো এ কারণেই আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম পালিয়ে যাবার নিরাপদ রুট খুঁজছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলেশা মার্ট ৮ হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের অর্ডার নিয়ে ডেলিভারি না দিয়ে মাসের পর মাস গ্রাহকদের ঘোরাচ্ছে। এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের আরও অন্তত ৫ হাজার পণ্যের অর্ডারের বেশিরভাগই আটকে রাখা হয়েছে। অথচ এসব পণ্যের অর্ডার দেয়া গ্রাহকরা আলেশা মার্টকে অগ্রিম টাকাও পরিশোধ করেছেন অনেক আগেই। শুধু মোটরসাইকেলের অর্ডার দেয়া গ্রাহকেরই ১৪৬ কোটি টাকা আটকে রেখেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি।

বিভিন্ন মাধ্যমে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে ই কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট। ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাজারে আসলেও কাস্টমারদের নানা ধরনের ভোগান্তিতে ফেলেছে তারা। গ্রাহকদের নানা প্রলোভনে ফেলে মেম্বারশিপ বিক্রি করেছে। কিন্তু মেম্বারশিপ এর যথাযথ কোন সুবিধা পায়নি গ্রাহকরা। অর্ডারের নামে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের সঙ্গে নানা কৌশলে প্রতারণা করেছে।

তারা বিভিন্ন প্রকার আন-অফিসিয়াল মোবাইল ফোন সেট বিক্রয় করেছে যা থেকে বাংলাদেশ সরকার অনেক রাজস্ব হারিয়েছে। আবার লোভনীয় অফার দিয়েছিল বাইকের উপর। বলা হয়েছে ১-৩৫ দিনে ডেলিভারি সম্পূর্ণ করবে। কিন্ত কাস্টমার বাইক অর্ডার করে রীতিমতো জিম্মি হয়েছে তাদের কাছে।

ই-কমার্স সেক্টরকে উদীয়মান অর্থনীতির বৃহৎ চালিকাশক্তি বলা হলেও নানান কূট-কৌশলে একের পর এক প্রতারণা করে যাচ্ছে আলেশা মার্ট চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম শিকদার। তার প্রতারণার জালে আটকা পড়ে হাজার হাজার পরিবার আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, আলেশা গ্রুপের ১,০০০ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। যদি এত সম্পত্তি থেকেই থাকে, তাহলে সেগুলো কোথায় এবং সে সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা দেয়া হচ্ছে না কেন?

আসলে আলেশা মার্ট তালবাহানা করে দিন পার করছে। আর সুযোগ বুঝে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছেন প্রতিষ্ঠানটির মঞ্জুরুল আলম শিকদার!

এআরআই

আর্কাইভ