• ঢাকা শুক্রবার
    ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি চাকরি কি আসলেই সোনার হরিণ?

প্রকাশিত: জুন ২১, ২০২১, ১১:১৭ এএম

সরকারি চাকরি কি আসলেই সোনার হরিণ?

তারিক ইসলাম

আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত কথা আছে, ‌‘বাংলাদেশে চাকরি পাওয়া অনেক কঠিন; চাকরি সবার কপালে জোটে না। সরকারি চাকরি হলে তো আর কোনো কথাই নেই। সরকারি চাকরি তো বাংলাদেশে সোনার হরিণ।’

উপরের কথাটি আংশিক সত্য হলেও, পুরোপুরি নয়। আবার এই কথাটি সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্যও নয়। আমার জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আপনারদের সঙ্গে কিছু শেয়ার করি-

আমি তখন খুব সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। আমার এক কাজিন অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে দীর্ঘদিন বেকার। আমার মা একদিন তাদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে, সে আমার মাকে বলল, ‘আন্টি, মিজানকে যে এত কষ্ট করে পড়াচ্ছেন, কী লাভ হবে? দেশে তো চাকরি নাই। দেখেন না, আমি আজ অনেকদিন ধরে একটা চাকরির  জন্য ঘুরে এখন পর্যন্ত একটা বড় চাকরি তো দূরের কথা, একটা ছোট চাকরিও পেলাম না!’

আমার মা পরবর্তীতে আমাকে একই কথা জিজ্ঞেস করলে, আমি উত্তরে বলেছিলাম, ‘আগে তো ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করি, তারপর দেখা যাবে কি করতে পারি না পারি। যদি ভালো করে পড়াশোনা করি, আর কপালে যদি চাকরি থাকে- চাকরি একটা পাবোই ইনশাল্লাহ।’ সেদিন হয়তো আমার মা আমার কথায় আশ্বস্ত হলেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি।

এখানে বলে রাখি, আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে অ্যাকাডেমিক পড়ার পাশাপাশি বিসিএসের জন্য টুকটাক পড়তাম। যেহেতু মাকে বলেছিলাম, ভালোভাবে পড়াশোনা করলে চাকরি একটা পাব-ই। তাই সেই দিনের পর থেকে আরও সিরিয়াসলি পড়াশোনা করতে লাগলাম।

এর মাঝে অনার্স শেষ হলো। ৩৪তম বিসিএসের সার্কুলার দিলো। আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে বসে আবেদন করলাম। ৩৪তম পরীক্ষার প্রিলি পরীক্ষার ডেট (তারিখ) তখনো দেয়নি। জীবনের প্রথম চাকরি ইন্টারভিউ দিলাম অ্যাসিস্ট্যান্ট রিজিওনাল ম্যানেজার হিসেবে ‘মাইওয়ান ইলেকট্রনিক্স’-এ বনানী হেড অফিসে। প্রায় ২০০ জন চাকরিপ্রার্থী থেকে তারা মোট ১৯ জনকে নিলো। আমি সেকেন্ড হলাম। কিন্তু ভার্সিটির বড় ভাই ও বাবা নিষেধ করলেন যেন এখনই প্রাইভেট চাকরিতে জয়েন না করি। না হয় আমার আমার যে স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার, সেটা হয়তো পূরণ নাও হতে পারে। কারণ প্রাইভেট জবে ঢুকলে পড়ার সময় খুব একটা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া মাস্টার্সের রেজাল্ট খারাপ হতে পারে।

জীবনের প্রথম চাকরি পেলাম; মাকে শোনানোর পর মা খুশি হলেও অনেক খুশি হতে পারেননি (কারণ মায়ের স্বপ্ন ছিল তার ছেলে একজন বিসিএস ক্যাডার বা ব্যাংকার হবে)। কিন্তু আমি প্রাইভেট চাকরিতে যোগদান করব কিনা এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। জীবনে প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ, আর প্রথম চাকরি সেটায় জয়েন করব না?

অবশেষে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। কপালে যা আছে, হবে; এত তাড়াতাড়ি প্রাইভেট চাকরিতে জয়েন করব না। সরকারি চাকরির জন্য আগে ভালো করে চেষ্টা করে দেখব। তারপর না হয় কোনো উপায় না থাকলে প্রাইভেট চাকরি করতেই যদি হয় করব।

প্রথম বিসিএস ৩৪তম। জীবনের বড় স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হব। ৩৪তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষার সিট পড়ল ঢাকা কলেজে। পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে বার বার গলা শুকিয়ে আসছিল। হাত-পা কাঁপছিল। তবে প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলো। শেষে দেখলাম জীবনের প্রথম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষা ভালোই হলো। আমার জীবনের প্রথম বিসিএসে প্রিলি, রিটেন, ভাইভা পাশ করলাম, কিন্তু কোনো ক্যাডার পেলাম না। নন-ক্যাডার পেলাম। এর মাঝে পূবালী ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। সিনিয়র অফিসার হিসেবে নিয়োগও পেলাম।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৩ এপ্রিল ২০১৬ সালের রাতে রেজাল্টা দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। এরপর প্রথম ফোনটা মাকে দিয়েছিলাম। আমি শুধু মাকে ফোনে এইটুকু বলতে পেরেছিলাম, ‘মা, আমি পূবালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়ে গেছি।’ মা আমার কথা শোনার পর কান্না করতে লাগলেন। আমিও কান্না করছিলাম, কেউ আর কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর আমি কথা বলতে না পেরে ফোন রেখে দিয়েছিলাম।

এরপর ৩৪তম বিসিএসে পিএসসি নন-ক্যাডার সেকেন্ড ক্লাস পোস্টে আমাকে সুপারিশ করল, যেহেতু আমি পূবালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে ফার্স্ট ক্লাস জবে ছিলাম তাই সেকেন্ড ক্লাস জবে জয়েন করিনি। এরপর ৩৫তম বিসিএসে স্বপ্নের সেই বিসিএস ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম।
আসলে কোনো জিনিস পাওয়ার তীব্র সৎ আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য পরিশ্রম করলে সেটা কিছুদিন আগে বা পরে পাওয়া যায়।
আমার ক্যারিয়ার জীবনের দুটি স্বপ্ন ছিল- প্রথমত বিসিএস ক্যাডার হওয়া, দ্বিতীয়ত ব্যাংকার হওয়া। দুটিই আমি পেয়েছি। তবে প্রথমে ব্যাংকার পরে বিসিএস ক্যাডার।

একটা বিষয় খেয়াল করবেন, কেউ কোনো কোটা ছাড়াই অল্প পড়েও চাকরি পেয়ে যায়, কেউ অনেক পড়েও টিকে না। আবার কেউ কেউ বার বার, একটার পর একটা সরকারি চাকরি পায় আর ছাড়ে, কেউ আবার একটি সরকারি চাকরিও পায় না। আমার মতে, এর মূলে রয়েছে কৌশল ও পরিকল্পনা এবং ভালো করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আপনি যখন প্রথমে একটা চাকরি পেয়ে যাবেন, এরপর দেখবেন একটার পর একটা চাকরি হয়ে যাচ্ছে। তখন কোনটা রেখে কোনটা করবেন, সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাবেন। তবে প্রথম চাকরি পাওয়াটা অনেক সময় অনেক কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

এজন্যই হয়তো নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘It always seems impossible until it's done.’ অর্থাৎ, ‘কোনো কাজ সম্পন্ন করার আগ পর্যন্ত তা সবসময় অসম্ভবই মনে হয়। ’কিন্তু আপনি যখন করে ফেলবেন তখন আর অসম্ভব মনে হবে না। তখন আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী ও নিন্দুক সবাই আপনার প্রশংসা করবে এবং আপনাকে বাহবা দেবে।

মনে রাখবেন, সমাজে নানা প্রতিকূলতা থাকবেই। সমাজের সকল মানুষ যেমন এক নয়, সকলের মন-মানসিকতাও এক নয়। কেউ আপনার ভালো কাজে উৎসাহ দেবে, কেউ বা আবার নিরুৎসাহিত করবে। এটাই স্বাভাবিক, আর এটাই আমাদের সমাজের বাস্তবতা। সবাই আপনার ভালো কাজে কিংবা স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকবে এমন কখনো ভাববেন না। তবে আপনাকে আপনার লক্ষ্য পূরণে অটুট থাকতে হবে। লক্ষ্য পূরণে পরিশ্রম করতে হবে। পরিশ্রম কখনো বিফলে যায় না। আল্লাহ সবসময় সৎ ও পরিশ্রমীদের সঙ্গেই থাকেন। সকল সৎ ও পরিশ্রমীর জন্য শুভ কামনা রইল।

সবুজ/এএমকে
আর্কাইভ