• ঢাকা শনিবার
    ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেন ওয়ার্ন-রশিদ খান হওয়ার স্বপ্ন সিয়ামের

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২২, ১২:০৮ এএম

শেন ওয়ার্ন-রশিদ খান হওয়ার স্বপ্ন সিয়ামের

ফজলুল করিম, কুড়িগ্রাম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল এক ভিডিওতে। সেই ভিডিওতে অল্প বয়সী এক কিশোরকে লেগ স্পিন করতে দেখা যায়। কী দুর্দান্ত লাইন, লেন্থ আর নজরকাড়া টার্নিং। এ যেন পুরোদস্তুর এক লেগ স্পিনার। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা এই কিশোরের নাম সামিউল ইসলাম সিয়াম। যার স্বপ্ন বিশ্বখ্যাত অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন আর আফগান রশিদ খানের মতো হওয়া।

বাবার অনুপ্রেরণায় মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয় তার। এরই মধ্যে এলাকায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছে সিয়াম। স্থানীয় ব্যাটারদের কাছে সিয়াম যেন এক আতঙ্কের নাম। লাইন, লেন্থ আর টার্নিংয়ে প্রতিপক্ষ দলের ভয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ক্ষুদে লেগ স্পিনার। তার খেলার কারিশমা দেখে বিভিন্ন পাড়া কিংবা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট থেকে খেলার ডাক আসে সিয়ামের।


স্থানীয় ভূরুঙ্গামারী সরকারি কলেজ মাঠেই নিয়মিত অনুশীলন করতে দেখা যায় সিয়ামকে। সেখানে সবুজ ঘাসের মাঠে বোলিং করছে সিয়াম। অপর প্রান্তে ব্যাট করছে একজন ব্যাটার। ডান হাতের কাঁধ বাঁকিয়ে লেগ স্পিনার কব্জির মোচড় দিয়ে বল করে। অপরিপক্ব পিচে বলের টার্ন দেখলে চোখ ফেরানো মুশকিল। বল লেগের দিক থেকে অফের দিকে ঘুরে যায় অনায়াসে। বেশির ভাগ সময়েই বল পিচে পড়ার পর ঘুরে অফসাইডে আবার স্টাম্পে উপড়ে ফেলছে। লেগ স্পিনার হিসেবে লেগ ব্রেক বল করে লাইন, দৈর্ঘ্য এবং বলের টপস্পিন বনাম সাইড স্পিনের পরিমাণে সামঞ্জস্য ঘটাতে পারে।

সিয়ামের ভাষ্য, আমি সাত বছর বয়স থেকে ক্রিকেট খেলি। ইউটিউবে শেন ওয়ার্ন, রাশিদ খানের বোলিং দেখে লেগ স্পিনার হওয়ার ইচ্ছে জাগে আমার। তারপর থেকেই চেষ্টা শুরু করি।

সে আরও বলে, আমি ভূরুঙ্গামারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। লেগ স্পিনার হওয়ার সুবাদে এলাকায় বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলি। জেলা বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪ এ সুযোগ পেলেও অর্থাভাবে কুড়িগ্রাম স্টেডিয়াম এসে খেলতে পারিনি। তবে বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁওয়ে সুনামের সঙ্গে খেলতে পেরেছি।

সিয়াম বলে, অজপাড়াগাঁয়ে আমার বাড়ি। অভাবের সংসার, আমাদের এ উপজেলায় ক্রিকেটের কোনো পিচ নেই। এখান থেকে কুড়িগ্রাম জেলা স্টেডিয়াম প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। সেখানে প্রশিক্ষণ নেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও শহরে মেস, হোস্টেলে থাকার মতো সামর্থ্য নেই।

এই ক্ষুদে লেগ স্পিনার বলে, আমার বিশ্বাস ক্রিকেট কোচের প্রশিক্ষণ পেলে আমার খেলার হাত আরও ভালো হবে। আমি স্বপ্ন দেখি, ভবিষ্যতে জাতীয় দলে খেলব এবং বিশ্বকাপ জেতাতে পারব। কিন্তু অভাবের কারণে কতদূর যেতে পারব তা একমাত্র আল্লাহ জানেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সামিউল ইসলাম সিয়ামের বাবা একজন গৃহশিক্ষক, ছিলেন ফুটবলপ্রেমী। কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সদর ইউনিয়ন গোপালেরপুর গ্রামের বাসিন্দা। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে চলে তার সংসার। চার সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দুঃখ-কষ্টে জীবন অতিবাহিত করলেও চোখেমুখে তার আকাশ সমান স্বপ্ন। সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষায় আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ার অদম্য ইচ্ছে কুরে কুরে খাচ্ছে তার অনুভূতিকে। অভাবের সংসারে তিনিও বেশি দূর এগোতে পারেননি। নিজে কিছু করতে না পারলেও ছেলেকে ফুটবলার না হোক ক্রিকেটার বানানোর স্বপ্ন দেখতেন তিনি। নিজের ইচ্ছে কবর দিলেও লেগ স্পিনার সিয়ামের স্বপ্ন অর্থের অভাবে ধূলিসাৎ হবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না খেলাপ্রেমী দেলোয়ার হোসেন ওরফে দুলু মিয়া। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতায় ছেলেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিতে না পারলেও হৃদয়জুড়ে উদ্দীপনা, উৎসাহ ও প্রেরণা ছিল সিয়ামের অন্যতম পাথেয়। শুধু ছেলের জন্য একটু সহযোগিতার আশায় দিন কাটছে দেলোয়ারের।

সিয়ামের বাবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাই-বোনদের মধ্যে সিয়াম মেঝো। বড় ছেলে সদ্য এসএসসি পাস করছে। সব ছোট ছেলে প্রাইমারিতে পড়ে। ছোটবেলা থেকে সিয়ামের ছিল ক্রিকেটের প্রতি অন্য রকম টান। ক্রিকেট বল না থাকায় গাছের পেয়ারা, গাছের সুপারি দিয়ে বাড়ি উঠানে একা একা বোলিং করত। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখে কষ্ট হলেও মাঝে মধ্যে ব্যাট আর রাবার ডিউজ বল এনে দিতাম। ও তাই দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলত। কিন্তু আমি জানতাম না সে লেগ স্পিনার কৌশল এভাবে আয়ত্ত করবে। সেদিন সোহাগ নামে এক ভাই ওর খেলা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়। সেদিনই জানতে পারি সে লেগ স্পিনারের প্রয়োজনীয় কৌশল বেশ রপ্ত করেছে।


দেলোয়ার আরও বলেন, ‘সিয়ামের লেখাপড়ার প্রতি আমি যথেষ্ট কেয়ার নেই। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি তার খেলাকেও প্রাধান্য দেই। কেননা খেলায় সুনাম অর্জন করুক, দেশের মানুষের মুখ উজ্জ্বল করুক- এটা মনেপ্রাণে চাই। তবে একটাই দুর্ভাগ্য, অর্থের অভাবে যেন ছেলেটার স্বপ্ন ডুবে না যায়।’ লেগ স্পিনার সিয়ামের জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠানসহ সবার সহযোগিতা কামনা করছেন বলে জানান তিনি।

সিয়ামের খেলার সঙ্গী রাফিক বলে, ‘সিয়াম লেগ স্পিনার হিসেবে খুব ভালো বোলিং করে। ওর বল খেলতে বেশ বেগ পেতে হয়। স্বাভাবিকভাবে খেলতে ব্যাটারদের সমস্যায় পড়তে হয়। সিয়াম একজন ভালো কোচের অধীনে প্রশিক্ষণ নিলে অনেক বড় একজন লেগ স্পিনার হতে পারবে।’

কুড়িগ্রাম ক্রীড়া সংস্থার কোচ বিজন কুমার দাস বলেন, ‘সিয়ামের  বোলিং অ্যাকশন দেখে বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৪এ নেই। সিয়াম গ্রামের ছেলে। একজন খেলোয়াড় হিসেবে স্মার্টনেস, বোলিং কৌশলে ওর কিছুটা দুর্বলতা আছে। তবে সিয়ামকে ভালো প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে দেশের লেগ স্পিনারের ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

কুড়িগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সাইদ হাসান লোবান বলেন, ‘সিয়ামের বিষয়টি আমি সামাজিক মাধ্যমে জানতে পেরেছি। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে প্রশিক্ষণ নিতে জেলা শহরে নিয়মিত আসতে পারেনি। আমার পক্ষ থেকে সিয়ামের থাকার ব্যবস্থা, খেলার সরঞ্জামাদি দিয়ে সহযোগিতা করতে পারব। কিন্তু কিছু বিষয় আছে যেখানে তার সহযোগিতা প্রয়োজন।

জেডআই/এম. জামান

আর্কাইভ