• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইভ্যালির চেয়ারম্যান-এমডি গ্রেফতার, অনিশ্চয়তায় গ্রাহকের টাকা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১, ০৯:২২ পিএম

ইভ্যালির চেয়ারম্যান-এমডি গ্রেফতার, অনিশ্চয়তায় গ্রাহকের টাকা

সফিকুল ইসলাম সবুজ

এত দিন তবুও আশা ছিল। ক্ষীণ হলেও স্বপ্ন ছিল আবার স্বরূপে ফিরবে ইভ্যালি। আবার আসবে চমকপ্রদ অফার। আবার শুরু হবে ডেলিভারি। বিলম্বিত হলেও ফিরে পাবেন বিনিয়োগকৃত টাকা অথবা কাঙ্ক্ষিত পণ্য। সে আশায় যেন পানি ঢেলে দিলো র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এর মাধ্যমে চরম অনিশ্চয়তায় পড়ল গ্রাহকদের বিনিয়োগকৃত টাকা।

ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাসেলের গ্রেফতারে বিচলিত গ্রাহকেরা। তারা মনে করছেন, তাদের গ্রেফতার করাটা কোনো সমাধান নয়। তাকে তার প্রতিশ্রুত ছয় মাস সময় দেওয়া হোক। এই সময়ের মধ্যে তিনি যদি গ্রাহকদের বিনিয়োগ কিংবা পণ্য দিতে না পারেন তখন আইনের আওতায় আনা যেতে পারে।

আবার কেউ কেউ মনে করেন, রাসেল দম্পতির পাসপোর্ট জব্দ করা আছে। তারা তো পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেননি। তারা ব্যবসা করতে চান। তাদের সময় দেওয়া উচিত। গ্রেফতার কোনো সমাধান নয়; বরং গ্রেফতার হলেই রাসেলের জন্য সুবিধা। তিনি কারাগারে থাকবেন আর গ্রাহকদের পরিস্থিতি হবে ডেসটিনির মতো। তারা টাকা চাওয়ার লোক পাবে না!


রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় তিনি জানান, গুলশান থানার প্রতারণার মামলায় মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় তার বাসা থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্ট ছাড়া অন্য কিছু উদ্ধার করা হয়নি। রাতে জিজ্ঞাবাদ করে এই বিষয় শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফিং করা হবে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে রাসেলের মোহাম্মদপুরের নিলয় কমপ্রিহেনসিভ হোল্ডিংয়ের বাসায় (হাউজ ৫/৫ এ, স্যার সৈয়দ রোড) অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযান শেষে মো. রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় বাহিনীটি। সেখান থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরা র‌্যাব হেডকোয়ার্টার্সে।

তবে অভিযানের সংবাদ শুনেই রাসেলের বাসার সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন গ্রাহকেরা। তাদের বাসা থেকে বের করার সময় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। এ সময় কিছু গ্রাহককে স্লোগান দিতেও দেখা যায়। ‘রাসেল ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’- এমন সব স্লোগান দিয়ে রাসেলকে নিয়ে যেতে বাধা দেন তারা। আবার অনেককে দেখা গেছে কান্নায় ভেঙে পড়তে। মূলত রাসেল ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করায় টাকা ফেরত না পাওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন গ্রাহকেরা।


কাঁদতে কাঁদতে হুমায়ুন নামের এক গ্রাহক বলেন, ‘আমি তিন লাখ টাকার চেক পেয়েছি। এখন রাসেলকে গ্রেফতার করা হলো। এখন আমার টাকার কী হবে। আমরা তো এত দিন আশায় ছিলাম, টাকা ফেরত পাব। কিন্তু তিনি যদি কারাগারে থাকেন, তাহলে তো আর টাকা ফেরত না-ও পেতে পারি। এখন কী করব, কোথায় যাব?’

সজীব নামে এক গ্রাহক বলেন, ‘এত দিন ভেবেছি, টাকা পাব। গ্রেফতার না হলে রাসেলের বাসায় অথবা অফিসে যোগাযোগ করা যেত। কিন্তু এখন কার কাছে যাব। আমার টাকার কী হবে? টাকা না পেলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবার কাছ থেকে টুকটাক করে, সমিতি থেকে টাকা নিয়ে আমি বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু সব তো শেষ হয়ে গেল। খুব কষ্টের টাকা ভাই, না পেলে আমার অবস্থা খুবই খারাপ হবে। অনেক দুশ্চিন্তায় আছি। আমি আর কিছু দিনের মধ্যেই টাকাটা পেয়ে যেতাম।’

ফয়সাল নামে প্রতিষ্ঠানটির এক গ্রাহক বলেন, ‘ইভ্যালি তো বলে নাই, তারা টাকা দেবে না বা পণ্য দেবে না। ইভ্যালি থাকলে মানুষ টাকা পাবে। প্রতিষ্ঠান না থাকলে তো টাকা পাবে না। তখন গ্রাহকদের টাকার জন্য পথে পথে ঘুরতে হবে। ইভ্যালিতে কষ্টের টাকা বিনিয়োগ করেছে মানুষ। ইভ্যালি না থাকলে মানুষ পথে বসবে। ই-অরেঞ্জ, ধামাকার পর ইভ্যালিও যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সব শেষ হয়ে যাবে।’


বিক্ষোভরত শাওন বলেন, ‘ইভ্যালি তিন বছর ধরে ব্যবসা করছে। তাদের ব্যবসা করার সুযোগ দিন। গ্রাহকদের টাকা পরিশোধে রাসেল ভাই ছয় মাস সুযোগ চেয়েছেন। মাত্র এক মাস শেষ হয়েছে। তার হাতে আরও পাঁচ মাস সময় আছে। তাকে মুক্তি দিয়ে এ পাঁচ মাস নজরদারিতে রাখা হোক। যদি তিনি ব্যর্থ হন, তবে তাকে গ্রেফতার করা হোক।’

এর আগে রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা করা হয়। এ মামলাতেই রাসেল দম্পতিকে গ্রেফতার দেখিয়েছে র‍্যাব। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গুলশান থানার ডিউটি অফিসার এসআই অনিন্দ তালুকদার। তিনি বলেন, ‘আরিফ বাকের নামে ইভ্যালির এক গ্রাহক মামলাটি দায়ের করেন। মামলার নম্বর ১৯।

মামলার লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে অভিযোগকারী আরিফ বাকের ও তার বন্ধুরা চলতি বছরের মে ও জুন মাসে কিছু পণ্য অর্ডার করেন। পণ্যের অর্ডার বাবদ বিকাশ, নগদ ও সিটি ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে পুরো টাকা পরিশোধ করা হয়। পণ্যগুলো ৭ থেকে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে ডেলিভারি ও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে প্রতিষ্ঠান সমপরিমাণ টাকা ফেরত দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে পণ্যগুলো ডেলিভারি না পাওয়ায় বহুবার ইভ্যালির কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধিকে ফোন করা হয়। সবশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর যোগাযোগের মাধ্যমে অর্ডার করা পণ্যগুলো পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন তারা।


এতে আরও বলা হয়, একপর্যায়ে ইভ্যালি পণ্য প্রদান ও টাকা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির ধানমন্ডির অফিসে যান। এ সময় এমডি রাসেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা উত্তেজিত হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। অফিসের ভেতরে অবস্থান করা রাসেল উত্তেজিত হয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ভয়ভীতি দেখান এবং পণ্য অথবা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে তারা চরম আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিন যাপন করছেন এবং পণ্য বুঝে না পাওয়ায় আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

মামলার এজাহারে রাসেল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় অপরাধের কথা বলা হয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ধারাগুলো হচ্ছে- ৪২০, ৫০৬ ও ৪০৬। দণ্ডবিধির ৪২০ নম্বর ধারায় প্রতারণা করে সম্পত্তি বা অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ অপরাধে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ও উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

এ ছাড়া ৪০৬ নম্বর ধারায় বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে সর্বোচ্চ তিন বছর জেল, অর্থ জরিমানা ও উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ৫০৬ নম্বর ধারায় ভুক্তভোগীকে হত্যা বা আঘাত করার ভয়ভীতি দেখানোর অপরাধের কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে অনেক দিন ধরেই নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল। গত ২৫ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও এমডির সব ব্যাংক হিসাব তলব করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এরপর গত ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে এক সভায় ইভ্যালির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি।


কেএই রাসেল?

মোহাম্মদ রাসেল রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ২০১১ সালে ঢাকা ব্যাংকে চাকরি নেন। চাকরির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করেন রাসেল। ৬ বছর পর ঢাকা ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার ব্যবসা শুরু করেন তিনি।

২০১৬ সালে প্রথমে অনলাইনে ডায়াপার বিক্রি দিয়ে যাত্রা শুরু করেন রাসেল। ২০১৭ সালে এই ব্যবসা করতে গিয়ে বড় একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কথা চিন্তা করেন তিনি। সেই চিন্তা থেকেই প্রতিষ্ঠা করেন দেশীয় ই-কমার্স কোম্পানি ‘ইভ্যালি’। প্রায় ১৭ লাখ নিয়মিত ক্রেতা, ২০ হাজারের বেশি বিক্রেতা নিয়ে বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতে স্বল্প সময়ে প্রথম সারিতে উঠে আসে ‘ইভ্যালি’।

এস/এম. জামান

আর্কাইভ