• ঢাকা শুক্রবার
    ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

দাগকাটা ভালোবাসা

প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২৩, ১০:২২ পিএম

দাগকাটা ভালোবাসা

দাগকাটা ভালোবাসা। নবনীতা সই।

নবনীতা সই

বস্তির পিছনে, ছাঁইভাটার কাছে পচা নালাটার পাশে ভন ভন করা মাছিগুলোর পাশে পেঁচো মাতালের মতন কেষ্টা পড়েছিল। গায়ে কটা পিঁপড়ে উঠে সুরসুর করে হাঁটছে। কাল রাতে কখন, এখানে এসে পড়েছে, টের পায়নি। 
আজ রোদের তেজে পিঠ পুড়ছে, তবুও শালা উঠতে ইচ্ছা করছে না। গায়ে হয়ত কাদা শুকিয়ে গেছে, কাল পড়ে গিয়েছিল, যখন বেজন্মা কালুটা মুখে ঘুষিটা মারলো। মাঝের আঙুলের বড় আংটিটা গালে বসে জ্বালা করে উঠেছিল, বে নির্ঘাত কেটে গেছে। সব ঝাড়ের শোধ নেবো, মনে মনে বিড়বিড় করে কেষ্টা। 
কাল কী নিয়ে ক্যাচাল হয়েছিল, মনে আসছে না। বিশু, কালু আর কেষ্টা মাল টানছিল, বেচু বাবুর দোকানের পিছনের ঝোপজঙ্গলের  জমিটুকুতে। দুটো ডুমুর গাছ যেখানে জড়াজড়ি করে দাঁড়ানো, তার নীচে। সহজে ওখানে কেউ আসে না। 
ছোটো বেলায় কেষ্টা রোজ সকালে পচা নালার পাশে হাগতে আসতো, নোনাফল আর ডুমুর গাছের তখন মেলা ছিল, কেষ্টা ভাবতো  ডুমুরফুল দেখে একদিন রাজা হবেই।
ঠাকমা বুড়ি বলতো, ডুমুরফুল দেখলে রাজা হয়। বা... রাজা হয়। 
একদিন ভোরবেলা দেখেছিল রতন বুড়োকে আমতলার বেলামাসিকে নিয়ে টানাটানি করতে। আর কোনোদিন যায়নি নালার পাড়ে। বড়দের মতন লাইন পড়ে যেত তারপর থেকে। মনে মনে বলতো, হাগুন্তির লজ্জা নাই দেখুন্তির লজ্জা। কে কথাটা বলেছিল, ধুর কানের কাছে মাছি বিনবিন করছে, মনে আসছে না কথাটা কার কাছে শুনেছে।

ওঠ ব্যাটা মিনসে! 
কেরে?
তোর যম। কাল থেকে নবাবপুত্তুর গুয়ে গোবরে চান মারছে, ওঠ! 
পারবো না। যা বাড়ি যা।
মুখপোড়া, গুখেগো, মর, মর! মরণ হয় না আপদের।
সারা রাত্তির আমি ঠায় বসে আছি আর মরা এখানে পড়ে আছে। 
একটা ভ্যান ডাক না শেফালি। 
মড়ার গাড়ি ডাকবো। চল বলছি ওঠ!

দুপুরে পান্তা খেয়ে টানা ঘুমিয়ে কেষ্টা যখন ওঠে, তখনো শেফালির গাল ভার। মেয়েটা বড্ড মুখরা। কিন্তু কেষ্টাকে ভালোবাসে খুব। কিরে কাজে যাসনি?
কি করে যাবো গুখোর? গেলেই তো গিলতে বেরোবি। 
আরে মাইরি বলছি, আজ যাবো না। মা কালীর কিরে। 
থাক থাক আর কিরে করা লাগবে না। তোকে কতবার বলেছি, চল সুবোদার কাছে। নাহ্ ওনার লাজ লাগে। 
শোন শেফালি, আমি গলির কুত্তা হতে পারি, কিন্তু হারামখোর নই। ঐ তোর সুবোদাটা না আমার চেনা আছে সব শালা ..... থুঃ।
হ্যাঁ তুই সব জেনে বসে আছিস। যেতে হবে না। যতদিন আমি আছি আমার হাড়মাস খা বসে। 
রাগিস কেন কমলাসুন্দরী? আরে দ্যাখ না, বিশুর সঙ্গে কাজে লেগেছি, কটা দিন যাক তোকে দেখাবো কেষ্টা কি জিনিস। 
থাক থাক আর মস্তানি করতে হবে না। আমি গেলাম। রাতের জন্য রুটি তরকারি করা আছে। 
আজ তোর কোথায় কাজ?
যেখানে যাই, তালতলা।
চল তোকে দিয়ে আসি।

সাইকেলে করে শেফালিকে কাজের জায়গায় নামিয়ে দিয়ে সোজা বিশুর আড্ডায় যায়। কাল কি নিয়ে লড়াই হলো, ব্যাটা মারলো আমার মুখে। শুয়োরটাকে! কিন্তু কালু বিশুর ভগ্নীপতি, শালা বিশু কিছু বলবে না হারামিটাকে।

কি রে ঘুম হলো?
হ্যাঁ বস। 
কাল খুব টেনেছিলি, শালা তোকে মেরে তো কালু হাওয়া হয়ে গেছে। রাতে বাড়ি ফেরেনি। তুই আবার কোন ঘোঁচ করিসনি তো বে? 
আরে বা... আমি তো এই উঠলাম।
যা হোক বা... মিটমাট করে নে। 
আমার কি দোষ বা... 
তুই তো গালি দিলি বে কালুকে।
আমি? মনে নেই বস, বিশ্বাস করো, ভদ্দরলোকের ছেলে আমি। মা কালীর কিরে।
থাক বে, লে আগুন দে। তোদের সব ন্যাকরাবাজী আমার দু’চোক্ষের বিষ। সবকটা শালা কাজের থেকে ক্যাচাল বেশি। শোন আমার সব ঠিক করা হয়ে গেছে, সামনে অ্যাকশান টাইম, আর তোরা নিজেদের মধ্যে ক্যাচাল মারছিস। চল ভিতরে চল সব বলছি, অনেক কথা আছে।

আজ শেফালির আর কাজ নেই। এত দিন যে রুগীর দায়িত্বে ছিল, আজ তিনি মারা গেছেন। শেফালি আসার কিছুক্ষণ আগে। প্রায় পাঁচ মাস শেফালি ছিল এই বাড়িতে। আয়া সেন্টার থেকে পাঠিয়েছিল। পাঁচ মাস রাতের ডিউটি করেছে। এই পাঁচ মাস প্রতিটি রাতে, শেফালি কামনা করেছে যেন মহিলা মারা যান। যদিও এটাই কাজ তার।
আয়ার কাজ করে সংসার চালায় শেফালি। তবুও খুব কষ্ট হতো। মহিলার ছেলে বৌ দু’জনেই চাকরি করে। মহিলা নাকি কোথাকার নাম করা দিদিমনি ছিলেন। খুব অসহায় লাগতো। 
শেফালি যখন গাঁয়ের স্কুলে পড়তো। তখন রমলা দিদিমনি ছিল। কি রাগী। কিন্তু কি ভালোবাসতো। ইনি হয়ত খুব রাগী ছিলেন, কিন্তু বিছানায় পড়ে গিয়ে কেমন অসহায়ভাবে চেয়ে থাকতেন। কথা বন্ধ, চলা বন্ধ। হয়ত কোনোদিন আমার মতন মানুষকে কাছে ঘেঁষতে দেননি, আর সেই আমার কাছে গা মুছতে হতো। পেচ্ছাব পায়খানা, ভগবান নিয়ে গিয়ে ভালো করেছেন। যারা সারাজীবন দাপিয়ে বেড়ায় তারা বিছানায় পড়ে গেলে খুব খারাপ লাগে। ছেলে বৌটা ভালো। কিন্তু সময় নাই তাদের। দিনে দুপুরে আয়া রেখেছিল দেখাশুনোর জন্য।
আজ লোকের ঢল বাড়িতে। শেফালি চলে যাবে কিন্তু বসিয়ে রেখেছে তাকে বৌটা। 
হট করে চলে যাওয়া বাজে দেখায়। কত লোক আসছে। শালা বড় লোকদের কেমন মাপা মাপা হাসি, মেপে মেপে কাঁদে।
এই যদি বস্তি হতো তো চিল চিৎকারে কাক বসতে পারতো না। একদিকে হয়ত ভালো।

অনেক মৃত্যু দেখেছে শেফালি। আয়ার কাজ তাই, প্রায় রাতে বাড়ি থাকে না। বাড়ি বলতে, বস্তির একচিলতে বারান্দাসহ, টিনের ঝুপড়ি। তবুও ঘর। আগে তো দালানে থাকতো। কিন্তু নিজের না। 
সেই চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছিল বাবা বিহারে। সেখানে পরপর তিনটে বাচ্চা নষ্ট করার পর, ছেলে হয়। কিন্তু শরীরে না ছিল শক্তি না রক্ত। একদিন আত্মীয় বাড়ি, বিয়েতে নিয়ে যাবার নাম করে কোলকাতায় বিক্রি করে চলে যায় নিজের বর। 
সেখান থেকে কেষ্টার হাত ধরে আজ এই বস্তিতে। সব কিছুর মাঝে শুধু বাচ্ছাটার জন্য কষ্ট হয়। যে দিন সেই লালবাড়িতে ঢুকেছিলাম, তার সাতদিন পর অপারেশন করিয়ে দিয়েছিল মাসি। ঐখানে মাসির লালবাড়িতে ঐ নিয়ম। বাচ্ছার ঝামেলা কে নেবে। খাও দাও, রাত রঙিন করো, কিন্তু বাচ্ছা-কাচ্চা চলবে না। 
পেটেরটা হয়ত শেফালিকে দেখলেও চিনবে না। শেফালি কি যেতে পারতো না বিহার? খুব পারতো। আজ শেফালি হিল্লি দিল্লি সব যেতে পারে।
শহরের জল পেটে পড়ে আজ শেফালি আর সেই শেফালি নেই। কি যেন নাম ছিল, কমলা। বাবা ডাকতো কমলাসুন্দরী। কিন্তু যাওয়া হয় না। বরের আগের পক্ষের বউটার বাচ্ছা হয়নি, পরেরটার তিনটে মেয়ে। শেফালি ছিল তিন নম্বর বউ। শেফালি জানে ঐ সব গাঁয়ে বন্দুকের জোর চলে। বিহারের ওসব গ্রামে আইন কানুন কিছু নাই।  আর ছেলেকে আনলেই ঐ লোকটা আবার কোন শেফালির জীবন নষ্ট করবে, ছেলের জন্য। শেফালি এটাও জানে, বড়দি শেফালির ছেলেটাকে বুকে করে রাখবে। তবুও ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মাঝে মাঝে কান্না পায়, ভীষণ জোরে কান্না। 
ডাক্তার ডেথ সারটিফিকেট দিল। তারপর শেফালি আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসলো মড়াবাড়ি থেকে। স্নান করতে হবে গিয়ে। কিন্তু জল থাকবে না। যেটুকু জল তোলা আছে তাতে কাজ চালাতে হবে।
কেষ্টা বাড়িতে আছে কি না কে জানে। ফোন করে যাচ্ছি, ধরছে না। নিশ্চয়ই মাল খেতে বসেছে। ব্যাটা মরে যাবে মাল খেতে খেতে। ছোট থেকে এক বুড়ির সঙ্গে থাকতো কেষ্টা, বুড়িটা মরার আগে বস্তির ঝুপড়িটা দিয়ে গেছে কেষ্টাকে। মা বাবা ভাই বোন কেউ নেই, বা হয়ত আছে কিন্তু কেষ্টা জানে না। ছোট থেকে ভিক্ষা না করে কাজ করতো কেষ্টা। বুড়িকে অনেক দেখেছে কেষ্টা। শেফালিও বুড়িকে ভালোবাসতো। বুড়ি মরার পর কেষ্টা যেন আরও মাল খায়। ছেলেপিলে তো কোনো দিন আমার হবে না, শেষে কেষ্টা না আমায় ছেড়ে চলে যায়। ভাবতে ভাবতে বুকটা কেঁপে ওঠে। 
কেষ্টা মাল খায়, মাঝে মাঝে দুজনে ঝগড়া হলে হাতাহাতি হয়। একদিন পাশের ঘরের বৌদি বলছিল, সহ্য করো কেন শেফালি? হাসি আসছিল শেফালির। কেষ্টা ওকে মেরেছে, ও কেষ্টার চুল ধরে টেনেছিল। মারামারিটা হয়েছিল- কেষ্টা আমাকে মিলের কাজে যেতে দেবে না আর আমি কেষ্টাকে মাল খেতে দেবো না। নেতারা কি বলে নারী স্বাধীনতা আরও বড় বড় বুলি, কিন্তু আমি বুঝি কেষ্টা আমাকে মিলের ম্যানেজারের হাত থেকে বাঁচাতে যেতে দেয়নি কাজে। আমাদের ভালোবাসা বড় মোটা দাগের হাসি কান্না সব মেশানো। শেফালি জানে কোনো ভালো কাজ পেলে, কেষ্টা খুব ভালো হয়ে যাবে। তাই সব বাড়ি থেকে রুগী সুস্থ হলে যে বখশীশ দেয়, সেগুলো শেফালি জমায়। ব্যবসা করবে সেই টাকায়। সব ঠিক হয়ে যাবে।

বস্তির মুখটায় অনেক লোক। শেফালির বুকটা ছ্যাঁক করে ওঠে। এখন বেশ রাত। শীতের মধ্যে এত লোক জড়ো হয়েছে তার মানেই কোনো লোচা হয়েছে। কেষ্টার কিছু হলো না তো? জোরে পা চালিয়ে শেফালি ভিড়ের মাঝে এসে পড়ে। সবাই কিছু না কিছু বলছে। কারোর কথাই বোঝা যাচ্ছে না। শেষে হারুর মা শেফালিকে দেখে কেঁদে ওঠে, কালু মার্ডার হয়েছে, বড় নালার পাশে বডি পড়ে আছে। পুলিশ কেষ্টা, বিশু, হারু সবাইকে তুলে নিয়ে গেছে। শেফালি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।
কি সব্বনাশ, হা হা করে কেঁদে ওঠে শেফালি, গাল পাড়তে পাড়তে ছোটে থানায়।

সাতদিন পর কেষ্টা ছাড়া পায়। সুবোদাকে ধরে তিন রাত শালাদের অনেক করে খুশি করে, তবে ছাড়াতে পারে কেষ্টাকে। নিজের জমানো সব টাকা পুলিশের হাতে তুলে দিতে হয়েছে।
কি বেদম পিটিয়েছে পুলিশ। হাত পা এখনো ব্যথা। কেষ্টাকে যে ডাক্তার দেখাবে তার উপায় নেই। এ কয়দিন কাজে যেতে পারেনি শেফালি। মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসে, তবে ভাবনাটা অন্য। 
আগে লালবাজারে অনেক বিক্রি হয়েছে শেফালি। আর সেটা কেষ্টাও জানে। কিন্তু কেষ্টার সঙ্গে থাকার পর, কোনো দিন আর পরপুরুষের বিছানায় যায়নি। কোনোদিন ভাবেইনি। আজ কেষ্টার কাছে যেতে কেমন লাগছে শেফালির। কেষ্টা যদি ছেড়ে চলে যায় সব জানার পর? 
কি ভাবছিস তখন থেকে কমলাসুন্দরী? আমি খুন করিনি তুই তো জানিস?
জানি। কালুকে পার্টির লোক মেরেছে।
তাহলে কি অত ভাবছিস?
সব তো চলে গেলো, খাবি কি?
মাফ করে দে রে। কাল থেকে আমি মিলের কাজে যাবো।
থাক থাক, সুস্থ হয়ে আমাকে উদ্ধার করো। আমি ভাবছি কাল কাজে বেরোবো। 
না তুই বিশ্রাম নিবি। আমি কি জানি না, আমি নেই বলে হারামিরা তোকে কি ছেঁড়া ছিঁড়েছে। সব টের পাই আমি। কদিন বিশ্রাম নে।
চোখের জল গড়িয়ে পড়ে শেফালির। তুই জানিস?
সব জানি। তোর হাঁটা দেখেই বুঝেছি, শেয়ালগুলো, কথা শেষ হয়ে পারে না, কেষ্টার গলার কাছে আটকে থাকা কান্নায়। 
সেই রাতে দুজনে প্রাণভরে কেঁদে নেয়, কারণ আগামী দিন অনেক ভালোবাসা নিয়ে দুজনের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই আগামীতে কান্না বারণ।

আর্কাইভ