প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২৩, ০৬:১৬ পিএম
শামীম আরা বাবলী
জোছনাবিহীন রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনকে বড় বেশি রহস্যময় মনে হয়।উড়ন্ত মনের তরুণ বয়স বাস্তবতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। জীবনের সকাল গড়িয়ে দুপুর।বর্ণহীন এই জীবনে আজ বড় বেশি মনে পড়ছে বিনুর কথা।
বিনীতা এসেছিল।পরনে নীল শাড়ী। আঁটসাট করে বাঁধা লম্বা বেণিতে সাদা ফিতা জড়ানো।বড় লাজুক স্বভাবের মেয়েটি।আমি ওকে বসতে বলিনি।বাসি কাজলে ম্লান হেসে তাই সে ধীর পায়ে খোলা দরজা গলিয়ে চলে যায়।
কেবল গল্প করতেই আসতো বিনীতা আমাদের বাসায়।কখনও সে মুখ ফুটে কিছু বলেনি।গল্প তো সে করতো না,গল্প শুনতে আসতো। অনেক গল্প।আমার গল্প, দেশের গল্প, রাজনীতির গল্প।
রাজনীতি পাগল আমি মা`কে বলি-----
---"মা, তুমি আমায় কেন রুদ্র নাম দিলে?আমি যে ঘর ছাড়া!"
---"পাগল ছেলে আমার।ঘরে বউ নিয়ে আয় দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।"
আমার ঝাকড়া চুলে বিলি কেটে মা বলতো।
বিনীতার হাসিতে আকাশের সৌদামিনীর ঝলক। আমার কথায় নাকি হাসির যাদু! তাই ও কাজল চোখের কালো মণিদুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথায় কথায় হেসে উঠত।হাসলে ওর কানের নীল পাথরের দুলদু`টিও ঝিলিক দিয়ে হাসতো।
আমার চোখ ফেরানো দায়! আর আমিও তখন ওর হাসির ঝিলিক দেখার লোভে আমার গল্পের ভৈরবী তুলি জলোদে।
চোখের ভাষায় সে কথা বলত।মুখে খুব কম।
মানুষের চোখেই যে এত সুন্দর ভাষা তা বিনীতাকে না দেখলে বোঝার অতীত।আমি
অনর্গল বকে যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মন্ত্রমুগ্ধের মত ও চোখেই দিত কমা, দাড়ি আর বিস্ময়ের
বহিঃপ্রকাশ। আমার গল্পের ভাষায় ঠাঁই পেত
"অবিরত গল্প বলা"!
শেষবারের মত বিনীতা ঘন সবুজ রঙের শাড়ী পরে এসেছিল।কপালে মস্ত বড় সিঁদূররাঙা টিপ।আমি ওর এলো খোঁপায় আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই ঝপ্ করে ওর খোঁপা এলিয়ে শরীর ঢেকে যায়।
বড় বড় পাপড়ি ছাওয়া অভিমানী চোখের পাতা তুলে বিনু আমার হাত সরিয়ে বলে---
---"কর কি রুদ্র দা! কর কি!"
বিনীতার চোখ বেয়ে অশ্রুবিন্দু টপ টপ করে
গড়িয়ে পরে। আমি অবাক বিস্ময়ে ওর অশ্রুবিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকি।
---"কি রে বিনু! তোর কি হয়েছে?"
---"রুদ্র দা! আমায় আশির্বাদ করবে না?"
---"কিসের আশির্বাদ রে বিনু!"
---"আমি তোমার আশির্বাদ নিতে এসেছি রুদ্রদা! আমার বিয়ে-----।"
হঠাৎ দমকা হাওয়ায় থেমে যায় আমার জীবনের ঢেউ।অপূর্ব একটি জীবনের স্বাদ যে আমার জন্য অলক্ষে পরম যত্নে অপেক্ষা করছিল আমি বুঝতে পারিনি।হায়! সময় কখনো ফিরে তাকায় না।বিনু আমার "অবিরত গল্প বলা"র শেষ যতি-চিহ্ন `দাড়ি` টেনে দেয়।আমি ইতির রেখায় সমান্তরাল।