• ঢাকা মঙ্গলবার
    ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ভিখারি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ১১:০৭ পিএম

ভিখারি

নার্গিস পারভিন, কলকাতা

ভিক্ষা দে এ এ বেন ন ন গো ও ও ও! ভিক্ষা আ আ আ! ঝন ঝন করে ওঠে একটা কণ্ঠস্বর। কলিংবেল টেপে না কোনো দিনও, দরজাও ধাক্কায় না। কেবল বাইরের সিঁড়িতে এসে ধপ করে বসে পড়ে আওড়াতে থাকে– ‘ভিক্ষা দেবেন গো, ভিক্ষা,,,,।

ওর কণ্ঠস্বরটা কখনোই শ্রুতি মধুর মনে হয়নি আমার কাছে। যেন মনে হতো গৃহিণীর হাত থেকে খসে পড়েছে একগুচ্ছ থালা বাটি। যার শব্দের অনুরণ প্রতিটা দেওয়ালে আঘাত করে ফিরে ফিরে আসে কানের পর্দায়। ওর আওয়াজটা অনেকটা তেমনিই। লিখতে বসলেই যখন ওই শব্দ কানে এসে পৌঁছায় নিমেষে ভাবনাগুলো ভেঙেচুরে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে- কাঁচ ভাঙার মতো টুকরো টুকরো হয়ে।

ওর নাম পেঁচি। এই শহরে বাস করলেও ওরা ক্যানেল পাড়ের বস্তিবাসী। সেখানে মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, চব্বিশ পরগনা, বিহার বা আরও অন্যান্য জেলা ও রাজ্য থেকে কাজের বা ভিক্ষার সন্ধানে ওদের এখানে আসা। কেউ ছিটে বেড়ার ঝুপড়ি ঘরে তো কেউ মাটির দেয়াল তোলা পুরনো ফাটা এসবেস্টার ছাওয়া ঘর ভাড়া নিয়ে। ভিখারি দিনমজুর পাড়া নামে পরিচিত পাড়াটি। সচরাচর বিত্তবান ও ভদ্র সমাজ ওদের পাড়া প্রয়োজন ছাড়া পেরানোর কথা ভাবে না।

ওর পেঁচি নাম কেন, জানা হয়নি কখনো। অবশ্য ওর চেহারাই বলে দেয়, বাবা-মায়ের অসন্তুষ্টির ফসল বলেই এমন একখানা নামের উৎপত্তি। চেহারা দেখেই আন্দাজ করতে পারা যায়। এবড়ো খেবড়ো দাঁত বেশ খানিকটা উঁচু। ওষ্ঠ দ্বয়ের ইঞ্চি দুই দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থান। উজ্জ্বল ঘোলাটে শ্যাম বর্ণ, খাটো চেহারায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে আঙ্গুলগুলো এলোমেলো হয়ে পেঁচি নামটাকে যেন সার্থক করে তুলেছে। বয়স আনুমানিক ত্রিশ হবে। হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক ওর এখনো বেমানান লাগে না। দশ-এগারোর কিশোরীর মতো, তবে রুগ্ন শুষ্ক কদাকার গাঢ় হলুদ চোখ তুলে জানতে চায়, ‘কেমন আছো মাস‘?
একটু হেসে, মেকি সহানুভূতি দেখিয়ে বলি, ভালো রে। তুই কেমন আছিস?
‍‍`তোমার দোয়ায় অনেক ভালো আছি মাসি। তুমি খুব ভালো। একটু জল খাওয়াবে? তেষ্টা পেয়েছে গো’।
সঙ্গে বিস্কুট বা মিষ্টি সহকারে বেশ যত্ন করেই জল দিই। একদিন একটা বোতল দিয়ে বললাম, এটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরিস। এখন ও জলের বোতল ভরে দেবার আবদার করে। মন্দ নয়।

মন্দ লাগে, যখন শুনি এই ভিক্ষা করা চাল, পয়সা নিয়ে না গেলে বাড়িতে ওকে মারধর করা হয়। ওর নানী মামা, মামী আর ছোট ভাই সবাই ওর ভিক্ষার চাল, পয়সার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই সমান ভাগ নেয়।
আজকাল প্রায় দিন দেখি সব্জি ভাতের আবদার করে আমার কাছে। এখন অবশ্য আর ওকে তেমন বিরক্ত লাগে না। প্রসন্ন মুখেই বলি, আচ্ছা, আসিস।
ওর মুখে খাবারের প্রশংসা শুনতে বোধহয় এখন ওকে খাওয়াতে  আগ্রহ বেশি লাগে। পাশে বসে শুনি ওর পরিবারের কথা।
তোর বাবা মা নেই?
‘সব আছে। বাবা অন্য বিয়ে করে মাকে ছেড়ে চলে গেছে’।
তোর মা?
‘মা ও বিয়ে করে নিয়েছে। আমি নানীর কাছে থাকি। ছোট ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকে’।
ও,,,
‘মামীর কাছে আমি আর নানী থাকি তো। আমি চাল, পয়সা নিয়ে না গেলে মামী নানীকে খেতে দেবে না। তাই তোমাদের দুয়োরে আসি গো মাসি’।
তোকে খেতে দেয় না? ওর চোখটা নিমেষে ছল ছল করে ওঠে। মাথা নিচু করে বলে ‘রাতের বেলা দুটো রুটি খাই। তরকারি থাকে না। একটু চিনি দেবে গো?’
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে ‘ঝাল খেতে পারি না গো মাসি। মরা বাড়ির বিয়ে বাড়ির ভাত তাই খাই না। আজ একটা মরা বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে। টিফিনে ভরে নিয়ে যাবো। ওরা খাব‘।
জিজ্ঞেস করলাম-ওরা কারা?
‘কেন, আমার নানী, মামা-মামী, ভাই সবাই’।
ওও

‘জানো মাসি, আমার অনেক ওষুধ লাগে। ওরা একটা পয়সাও দেয় না আমাকে। তাইতো পুরনো জামা কাপড় চেয়ে বিক্রি করি। ওই পয়সাটা দুদিন পরে লিতে যা ‘।
কেন?
‘ও পয়সা তো সোজা ওষুধের দোকানে জমা করি। আর দেয়ালের ফুটোয় ওষুধ লুকিয়ে রাখি। ওরা দেখলে তো আমাকে চোর বলবে। আমি এক পয়সাও লুকাই না গো মাসি’। ও কেঁদে ফেলে।
কোন ডাক্তার দেখাস তুই?
‘ওষুধের দোকান গো। বললেই ওষুধ দেয়। ওরাও তো ডাক্তার। দোকানের ডাক্তার অনেক ভালো। চেম্বারের ডাক্তার তাড়িয়ে দেয় গো মাসি’।
আমি আর কিছু বললাম না। উঠে কয়েক মুঠো চিনি ঠোঙায় ভরে দিয়ে বললাম, আর ভাত নিবি?
‘না মাসি। তরকারিটা এত ভালো লাগলো তাই সব ভাত খেয়ে নিলুম। রাতে আর খাবোনি আজ’। 
বেশ তৃপ্ত মুখটা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘উঠি গো মাসি। মরা ঘরের ভাত নিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ওরা না খেয়ে আছে তো। মামা কাজ থেকে ফিরে এলেই খাবার চাইবে। আসি গো,,,‘
আমি তাকিয়ে রইলাম ওর বৃহৎ স্টিলের থাক বাঁধা টিফিন ক্যারিয়ারের দিকে।

(সমাপ্ত)

আর্কাইভ