পুতুল জেসমিন
* আমি তার চিঠির প্রতিক্ষায় রইতাম--
বই পড়া, ডাইরি লেখা, আর চিঠি লেখা- এই তিন কাজ করি ছোটবেলা থেকেই।
কখনও প্রকাশ্যে, কখনও লুকিয়ে।
ছোট্ট বেলার এক বন্ধুর কাছে চিঠি লিখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে।
হরষ, বিষাদ, আনন্দে মাখামাখি ছিল সে চিঠিগুলো।
কি ভিষণ অপেক্ষা ছিল যাকে লিখতাম তার কাছ থেকে চিঠি প্রাপ্তির।
ওই ছোট বেলায় কেমন করে যে মনের কথাগুলো পাহাড়ের চূড়ার বুক থেকে
জন্ম নেওয়া দুকূল প্লাবিত করা ঝর্ণা
ধারার মতো তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ
নৃত্যের ছন্দে আমার কাগজে কালির আঁচরে অক্ষর, শব্দ, বাক্য হয়ে উঠতো- এখন ভাবতে গেলেই অবাক হয়ে যাই।
চিঠির মাধ্যমে একজন মানুষকে চিনতে, একজন মানুষের সৃজনশীলতা জানতে পারা যায়।
আমরা যখন নীলফামারী ছেড়ে দিনাজপুর এবং দিনাজপুর ছেড়ে বগুড়ায় এলাম তখন চিঠি বিনিময় হতো খুব বেশি।
কলেজে গিয়ে দুইটা শালিক পাখি দেখলেই ভেবে নিতাম "চিঠি এসেছে।"
বাসায় ফিরে ঠিকই পেতাম। দিনাজপুর ছেড়ে বগুড়ায় এলাম, তখন হাজার হাজার চিঠি বিনিময় হয়েছে বন্ধুদের কাছে।
আমি রঙিন খাম, খাঁকি রঙের পোস্ট অফিসের খাম সবই ব্যবহার করেছি।
* By AIR MAIL* লেখা নীল খাম ছিল আমার ভালোবাসার খাম।
এমন কি আমার বান্ধবীর বাবার প্রেস থেকে নিজের নামে রাইটিং প্যাডও ছাপিয়ে নিয়েছিলাম। প্রতিদিন কারোর না কারোর চিঠি পেতামই।
আব্বা রেগে যেতেন।
চিঠি এবং ডাইরি লেখায় আমি ওস্তাদ।
ছোট বেলা থেকে একজন আমাকে
চিঠি লেখতো। সুন্দর সুন্দর চিঠি।
সে আট বছর নিয়মিত আমাকে চিঠি
লিখিয়েছে। দু'জনে দু'জনার চিঠির জন্য
পাগোল ছিলাম।
আমি যখন বগুড়ায় চলে এলাম-
তখন অধীর আগ্রহে তার চিঠির
অপেক্ষা করতাম। দিনে দিনে আমার আগ্রহ- উৎকণ্ঠা, ভয়, আশঙ্কায় পরিণত হলো।
এক দিন, দুই দিন, তিন দিন, সাত দিন, পনের দিন, মাস, বছর চলে যায়, তার চিঠি আর আসে না।
এলো না তো এলোই না। সে থেমে গেল, নীরব হলো। চিঠি লেখা বন্ধ করলো।
কেন এমন করলো তা আমি জানতে পারিনি। জেনেছি অনেক দেরিতে। ---
হাতে মোবাইল এলো।
আব্বার ঠিকানায় ডাক পিয়ন আর চিঠি দিতে এলো না।
ডাকঘরের মাধ্যমে একটা খামই পেতাম তখন-
যেখানে লেখা থাকতো -
* কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহৃত।*
* জেসমিন আখতার পুতুল *
প্রযত্নে জাবেদ আলী সরকার।
ফুলবাড়ি উত্তর পাড়া।
বগুড়া। পোস্ট কোড- ৫৮০০*
বিয়ের পরে ঠিকানা পরিবর্তন হয়ে গেলো।
এখন আর এই চিঠি (চুক্তিপত্র) আসে না।
এখন মোবাইল ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়- আমার সঙ্গীত রেকর্ডিংয়ের তারিখ।
ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।
ডাকঘর বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে
নিজ হাতে কাগজে লেখা চিঠি
না পাঠালেও আমি Messenger-এ চিঠি লিখি। দুর্মুখেরা বলে-- এই লেখা পড়তে আমার দুই মাস সময় লেগে যাবে!!
এক সময়ে যারা প্রতি মুহূর্ত অপেক্ষা করতো আমার চিঠি প্রাপ্তির এখন তাদের চিঠি পড়ার সময় নেই।
মানুষ এখন ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত।
চিঠি পড়বে কখন? মানুষ ছুটছে শুধু ছুটছেই অজানা এক গন্তব্যের দিকে।
মানুষের এই দৌড় দেখে আমার কেবলই মনে হয়-
" নদীর কূল নাই কিনার নাইরে---"*
আমার কাছে নিজেকে তুলে ধরার, অন্যকে জানবার জন্য চিঠির কোনো বিকল্প নেই।
আর একটা প্রসঙ্গ--
তখন ছিল বন্ধুত্ব মানেই তো চিঠি লেখা।
চিঠি প্রাপ্তির জন্য কি ভিষণ প্রতীক্ষা!!!
চিঠি এলো -- * অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো।*
আর একটি কথা এখন হয় * Facebook friend*
আমাদের সময় হতো-
* Pen Friend*
দেখা নেই, জানা নেই- অথচ হাজার হাজার মানুষের Pen Friend ছিল। এই কলমি বন্ধুত্ব বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছে।
আমার এক বন্ধুর বিয়ে হয়েছে Pen Friend এর সঙ্গেই।
আমার Pen Friend ছিল না।
তবে আমার বন্ধুদের সঙ্গে চিঠি বিনিময় ছিল গভীর সম্পর্কের বিনি সুতোর মালা।
---- ভালোলাগা,
ভালোবাসার
এক স্বর্গীয় অনুভূতি জড়িয়ে থাকা তিনটি নাম--
* ডাকঘর, ডাক বাক্স, আর
ডাক পিয়ন!
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন