• ঢাকা শনিবার
    ০৫ এপ্রিল, ২০২৫, ২২ চৈত্র ১৪৩১

দিনের_শেষে

প্রকাশিত: জুন ১৯, ২০২২, ০৮:৪৯ পিএম

দিনের_শেষে

মালবিকা পাণ্ডা

খুক খুক করে কাশতে কাশতে গিরিবালা তার স্বামী কে ডাকছেন, "কই গো! কোথায় গেলে! একবার এসো এই দিকে! আমাকে একটু ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে চল। "উফ কি কষ্ট! আর পারছি না। ঐ মানুষটারও বয়স হয়েছে। এই বয়সে আমার সেবা করছে। আমার কেন যে মরণ এখনও হল না। আপন মনে বিড়বিড় করছেন গিরিবালা। স্বামী রান্না ঘর থেকে শুনতে পেয়ে উত্তর দিলেন "আসছি গো, হয়ে গেছে তোমার জন্য দুধ গরম করতে দিয়েছি।"
বলেই আস্তে আস্তে তিনি স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, "আমার হাতটা শক্ত করে ধর গিরিবালা, তারপর আস্তে আস্তে ওঠার চেষ্টা কর। গিরিবালা স্বামীর হাতটা শক্ত করে ধরে উঠে ধীরে ধীরে বাথরুমে গেলেন। স্বামী বাইরে থেকে বললেন, "ভিতর থেকে লাগিও না, একটা বালতি যদি পারো দরজায় দিয়ে দাও, আমি সরে যাচ্ছি এখান থেকে। 
      
বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। গঙ্গাধরের হাতটা ধরে গিরিবালা বুকের কাছে এনে বলেন, "তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে নাগো!'
স্বামী গঙ্গাধর গিরিবালার হাত থেকে নিজের হাতখানা মুক্ত করে স্ত্রীর এলো চুল সরিয়ে দিতে দিতে বললেন, "আমি অসুস্থ হলে তুমি বুঝি আমাকে ফেলে দিয়ে চলে যেতে!" 
   এমন অলুক্ষণে কথা একদম বলবে না। তোমার কিছু হবে না। তুমি সুস্থ থাকবে। তোমার সব রোগ ভগবান যেন আমাকে দেন।" হ্যাঁ গো! তনু আজ ফোন করেছিল? 

 তোমাকে আমি কতবার বলেছি, "তোমার তনু সরকারি চাকরি করে না। সে এখন একটা কোম্পানির বড় পদে আছে। ইচ্ছে করলেই ফোন করতে পারবে না। যতক্ষণ না কাজ শেষ হচ্ছে ততক্ষণ ফোন করতে পারবে না।"
       গিরিবালা স্বামীর কথাগুলো চুপচাপ 
শুনছিলেন। সত্যিই তো! কোম্পানির চাকরি তো এই রকমই। এদের সংসার, বাবা মা বলে কিছু 
নেই। মা অসুস্থ হলেও ছুটি পাবে না। হায় কপাল! 

  তুমি তো এই রকমই চেয়েছিলে গিরি, ছেলে বাইরে চাকরি করবে। মাঝে মাঝে বাড়ি আসবে। তুমি তার জন্য কত রকম রান্না করবে। তাহলে এখন মন খারাপ কেন করছো। 

 "হ্যাঁ চেয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে একটা সন্তান হওয়া খুব খারাপ। দুটো সন্তানই ভালো।" 

     গিরিবালার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন গঙ্গাধর। "কি যে বল তুমি গিরি বাচ্চাদের মত।"
আর একজন থাকলে সেও তো পড়াশোনা করে বাইরে চাকরি করতে চলে যেত। তখন কি বলতে! তিনটে হলে ভলো হতো।

   এই জন্যই বলে মেয়ে ভালো। বাবা-মায়ের পাশে থাকবে। কেন যে মানুষ ছেলে ছেলে করে বুঝি না।
আমার মেয়ে হলেই ভালো হত। 

   তুমি আবার ভুল করছো গিরি। মেয়ে হলে তার বিয়ে দিতে হত। তারপর তারা বাইরে চলে যেত। 
এই যে তোমার ছেলের বৌ। সে তো কোনো বাবা মায়ের মেয়ে। সে কি তার বাবা মাকে দেখার জন্য নিজের সংসার ছেড়ে চলে আসতে পারছে? তাহলে তোমার মেয়ে থাকলে সেই বা আসতো কি করে? আমাদের আশা করাটাই অন্যায়গিরি। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সংসার হবে, ছেলে মেয়ে হবে। তাদের পড়াশোনা তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করবে। তারাও বড় হয়ে চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। এটাই জীবনগিরি। ছেলে বলো, মেয়ে বলো কেউ থাকবে না পাশে । থাকবো শুধু আমরা দুজন। 
         অত দূরে চাকরি করতে যাবার দরকার কি বলতো? কাছাকাছি হলে তো ভালো হতো। 

   হাসতে হাসতে গঙ্গাধর বলেন, "ছেলে বেকার হয়ে থাকলে বাবা-মায়ের কাছে থাকবে।" সেটা কি তুমি চাও? তাছাড়া এখন চাকরি কোথায় গিরি! কত ছেলে - মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চাকরির জন্য। ভাবলে কষ্ট হয়। কি আমাদের দেশগিরি! কত মানুষ এই দেশটার জন্য জীবন দিয়েছেন, তখন বোধহয় তারা ভাবেননি, দেশটার এই হাল হবে! 

   না না! এমন কথা মুখে এনো না। কোনো ছেলে যেন বেকার না থাকে। বেকারত্বের জ্বালা কি সে তো অনেকের দেখেছি। আসলে কি জানো তো, আমাদের মতো বাবা মা কে দেখার মতো কেউ নেই। বলো! তাছাড়া বয়স হয়ে গেলে তাদের চিন্তা ভাবনাটা পাল্টে যায়। 

 গঙ্গাধর গিরিবালার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলেন, "কে বলেছে নেই। আমি তো আছি।
সেই যে বিয়ের দিন থেকে যাকে তুমি সারাদিন গালাগালি করতে। "কি যেন বলতে তুমি আমাকে, "মিটমিটে শয়তান, কলির কেষ্ট, পালের গোদা" আরো কত কি । এখন মনে পড়ে না ঠিক মতো। অনেক আগের ঘটনা তো! তারপর গিরিবালা র দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, আমার খুব ভালো লাগতো জানো তো! যখন তুমি ঐ বিশেষণগুলো প্রয়োগ করতে। 

  গিরিবালা স্বামীর কথা গুলো শুনে মুচকি মুচকি হেসে বলে,"বুড়ো ভাম"। তুমি আমাকে বলোনি! বাপরে! একদিন বাপের বাড়ি চলে গেছলাম, কি অভিমান! কত জ্বালিয়েছো আমাকে। দেখতে দেখতে কত বছর হয়ে গেল। মনে হয় সেদিনের ঘটনা। 
এটাই সব বাবা-মায়ের জীবনগিরি। একটা বয়সে দেখার মতো কেউ থাকে না কাছে। সেই থাকে যার সঙ্গে জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। ছেলেরা করে না, এই কথাটা সব ক্ষেত্রে  ঠিক নয় গিরি। আমি যখন চাকরি নিয়ে চলে আসি। তখন আমিই কি বাবা-মায়ের করতে পেরেছিলাম। ছুটি পেলে তখন যেতাম। তনুর ছেলেও একদিন বড় হয়ে অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে চলে যাবে, তনু আর বৌমা একা হয়ে যাবে আমাদের মতো। এখানে ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তবুও আমরা এখন মোবাইলে তাদের দেখতে পাচ্ছি। এটাই কি কম কথা। তোমার মনে আছে গিরি, তনু যখন ছোট ছিল, তখন বাবা চিঠিতে কি লিখতেন? 

      গিরিবালা গায়ে দেওয়ার জন্য চাদরটা টানতে যাবে, তখন গঙ্গাধর বলে ওঠে, "দাঁড়াও আমি টেনে দিচ্ছি। আমাকে বলবে তো! নিজে এই শরীরে কেন 
বেশি নড়াচড়া করছো। তারপর গঙ্গাধর একটা চাদর গিরিবালার গায়ে দিয়ে দিল। গিরিবালা চাদরটা ঠিক করে নিয়ে বলল, "মনে থাকবে না আবার! "খোকা দাদুভাইয়ের একটা ছবি পাঠা।"
সত্যি এখন বুঝতে পারি, "ঐ মানুষ গুলো সেদিন কত কষ্ট পেয়েছিল। ছবি তুললেই তো আর সঙ্গে সঙ্গে দিত না, দশ- পনেরো দিন অপেক্ষা করতে 
হত। তারপর পাঠাতে হত। কতদিন পর পৌঁছাবে ঈশ্বর জানেন! আমরা তো তাদের সঙ্গে কথা বলি, গল্প করি। আর তারা! কথা বলতে বলতে গিরিবালা তার স্বামীর হাতটা জোর করে চেপে ধরে বলে, "হ্যাঁ গো- একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ঠিক ঠিক জবাব দেবে।"

      গঙ্গাধর একটু বৌয়ের সঙ্গে রসিকতা করে বলেন, "এই বয়সে প্রেম করছি কিনা জিজ্ঞেস করবে।"
      "আরে দূর! করার সময় প্রেম করনি, আর এই বয়সে।" আমি অন্য কথা বলছি। 

    আচ্ছা বল কি কথা! আমি উত্তর দেবার জন্য তৈরি ম্যাডাম। 
        একজন মায়ের তার সন্তানের জন্য যে কষ্ট হয়, একজন বাবার ও কি ঠিক সেই রকম কষ্ট হয়? 

     কথাটা শুনে গঙ্গাধর নিচের ঠোঁটটা একবার কামড়ে নিয়ে বলল, "তোমাদের কি মনে হয় গিরিবালা? বাবারা কি পাষাণ! তাদের মন বলে কিছু নেই। তোমাদের যতটা কষ্ট হয়, আমাদের তার কম নয় বরং বেশি হয়। আমাদের কষ্ট টা প্রকাশ করি না, বা করতে পারি না। তার মানে এই নয় যে আমাদের কষ্ট হয় না। 

     জানো তো, কোনো ভালো রান্না করলে বা পিঠে করলে তনু, বৌমা আর দাদুভাইয়ের জন্য মনটা কেঁদে ওঠে। বলতে বলতে গিরিবালার চোখ ছলছল করে উঠলো। 
     ও! এই জন্য তুমি সেদিন পিঠে খেলে না। হাসতে হাসতে গঙ্গাধর বলে গিরিবালাকে। 

      হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো। আমি খেতে পারলাম না। তনু ভীষণ ভালোবাসে পিঠে খেতে। তোমার পেট খারাপ ছিল বলে তুমিও খেলে না। কাজের মেয়েটাকে দিয়ে দিলাম। 

     গঙ্গাধর গিরিবালার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, শরীর খারাপ আমার ছিল না গিরি। আমি খেতে পারলাম না তনুর জন্য। বাড়িতে পিঠে হলে কি রকম করত! কোনো খাবার খেত না। সারাদিন পিঠে খেয়ে থাকতো। 

    হাতটা গঙ্গাধরের হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে, ভ্রু কুঁচকে গিরিবালা বলে "তোমার শরীর খারাপ ছিল না! তুমি তনুর কথা ভেবে খাও নি!" বলেই চোখ থেকে জল পড়তে শুরু করল। 

       গঙ্গাধর গিরিবলার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে, "কাঁদতে নেই গিরি! এতে আমাদের ছেলের সুখের পথ পিছল হয়ে যাবে। আমরা পুরুষরা কেন কাঁদতে পারি না জানো? আমরা কাঁদলে তোমরা আরও অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়বে। তোমাদের শক্ত রাখার জন্য ভগবান আমাদের এই ক্ষমতাটা দিয়েছেন। তাই আমরা কান্না কে চেপে রাখি। এবার ওষুধ খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়। ততক্ষণ আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। গিরিবালা গঙ্গাধরের ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে জোরে চেপে ধরে রাখলো আর গঙ্গাধর বাম হাত দিয়ে গিরিবালার মাথায় হত বুলোতে বুলোতে বলল, "জানো গিরি, "আমরা সবাই এক পথের পথিক।"  চলতে চলতে কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কেউ আপন হয় মনের কথা খুলে বলে, কেউ একসঙ্গে হেঁটে শেষে নিজের পথে চলে যায়, আবার অনেক খারাপ মানুষও থাকে। সব ক্ষণিকের দেখা। দিনের শেষে আমরা সবাই একা। আবার দেখো পাখিরা সারাদিন ঘুরে ঘুরে খাবার জোগাড় করে, শ 'য়ে শ'য়ে পাখি একসঙ্গে থাকে, দিনের শেষে কুলায় ফেরে একা। এটাই জীবনগিরি। দিনের শেষে আমরা সবাই একা। বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো গিরি। নিজের ডান হাতটা গিরিবালার হাতের মুঠো থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত করে, চাদরটা গিরির গায়ে ভালো করে 
ঢাকা দিয়ে দরজাটা একটু টেনে দিয়ে চলে গেলেন রান্না ঘরে গিরির জন্য খাবার বানাতে। 

আর্কাইভ