• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

মরচে পড়া

প্রকাশিত: মে ১২, ২০২২, ০৫:২৭ পিএম

মরচে পড়া

চিত্রা কুণ্ডু বারিক

মণীশ বাবু  চল্লিশ বছর পর নিজের ভিটেতে ফিরে এলেন। ষাটের দশকে এই বাড়িতেই তার জন্ম। তখন হৈচৈ ছিল আনন্দময় জীবন ছিল। ছিল মাঠেঘাটে বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়ে বেড়ানো। দুপুর বেলা অন্যের বাগানের গাছে উঠে ফল চুরি। কত কিছু জীবনের হিসাব নিকাশ সেখানে লেখা আছে। পাড়ার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে মায়ের কাছে নালিশ ছিল তার বিরুদ্ধে। শাস্তি ছিল কান ধরে নীলডাউন হয়ে হেঁটে বেড়ানো। হাঁটু ছিঁড়ে হয়ে যেত রক্তারক্তি কাণ্ড। তবুও মা ছাড়তেন না- উঠে দাঁড়ালেই পিঠের ওপর লাঠি পেটা। তারপর শাস্তি মওকুফ হলে সারারাত জেগে মা মলম লাগিয়ে দিতেন। পড়াশোনায় তুখোড় ছিলেন মণীশ বাবু। তাকে হারানোর লোক ছিল না কেউ।‌

মফঃস্বল এলাকায় ছিল সেই বাড়ি। দাদুর আমলে। পেল্লাই পেল্লাই সাইজের দরজা জানালা। ঘরের আকার দেখলে মনে হয় যেন ছোটখাটো খেলার মাঠ।‌ যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন। সবাই আস্তে আস্তে চাকরি সূত্রে বাইরে চলে যায়। মণীশ বাবুও ভালো ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে যান। এবার নতুন চাকরিস্থলে চলে যাবার প্রস্তুতি। ঠিক এই সময় বাড়ির মানুষগুলো বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগে। শেষ পর্যন্ত ধূমধাম করে ভালো মেয়ে দেখে তার নতুন সংসার পেতে দিয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘ চল্লিশ বছর বাইরে থাকা। কিন্তু একটা সময় দেখলেন স্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হচ্ছে। বুঝতে পারলেন সংসারে ধীরে ধীরে মরচে পড়তে শুরু করেছে। তবুও মানিয়ে চলার চেষ্টা। কিন্তু না, হঠাৎ করেই স্ত্রী সংসার জীবন থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেলেন নিজের মতো করে। আপত্তি ছিল না মণীশ বাবুর। কারণ জীবন নিজের মতো তাই মরচে ধরার আগেই তাকে ঘষে ঘষে তুলে দেওয়া উচিত। 

এবার তিনি ভীষণ একাকী অনুভব করতে লাগছিলেন, কিন্তু নীরবে নিভৃতে সেই অনুভুতিগুলো নিয়ে চর্চা করতেন। একদিন তাই মনে পড়লো এই পুরনো ভিটেমাটির কথা। সেখানে এখন একটি কেয়ারটেকার ছাড়া কেউ নেই। বাড়িতে কেউ না থাকায় কারেন্ট নেই। দেওয়ালে রং নেই । খসে পড়া পলেস্তারা, ঘুন ধরেছে দরজা জানালা। গ্রীলগুলো মরচে লেগেছে ঠিক মণীশ বাবুর সংসারের মতো। তবুও ইচ্ছে হলো কিছুদিনের জন্য সেই ভিটের সোঁদা গন্ধ নেবেন। 

অগত্যা একদিন হঠাৎ করেই চলে এলেন। কেয়ারটেকার লম্ফের আলো নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে এলো। আজকাল সেও বৃদ্ধ হয়েছে তাই চোখের দৃষ্টি কমেছে। গলার স্বর কানে পৌঁছোতে চিনতে পারলেন তার ছোট মণীশ এসেছে। বললেন বাবা মনীশ কদিন ধরেই খুব মনে পড়ছে তোকে। তা একবার বলে তো আসবি। ঘরদোর গুছিয়ে রাখতাম।‌ এখন শুবি কোথায় বলতো বাবা। গোটাবাড়ি ধুলোয় লুটিয়ে। বেশ একটু বসো আমি যাই একটু রান্নার ব্যবস্থা করি গিয়ে। বুড়ো হয়েছি কি না তাই একটু সময় লাগবে। ততক্ষণে তুই বরং কুঁয়ো পাড় থেকে গা হাত ধুয়ে আয়। তারপর কোনো রকম আজ রাতটা ধুলোয় গড়িয়ে নে কাল সব ঝেড়েমুছে দেব। 

মণীশ বাবু বললেন ও গঙ্গা কাকা এতো ভেবো না। আসার সময় সঙ্গে কিছু খাবার নিয়ে এসেছি। এসো দু'জন মিলে ভাগাভাগি করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি গে ।

পরদিন সকালে সারা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন। মনে হচ্ছে তার মা ডেকে উঠলেন "ও... খোকা এসেছিস বাবা কত ভালো লাগছে। চেহারা খারাপ হয়ে গেছে তোর। কিন্তু জানিস বাবা, তোর ওই চাঁদমাখা মুখটা  অবিকল সে-ই আছে। ডাক শুনে ছুটে যায়।’’ কিন্তু না চারদিক সব ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই- সবটাই মায়াময়। মনে হচ্ছে তার ছোটোবেলা ছুটছে তাদের বাগানের দিকে। কত ধরনের গাছ, পেয়ারা, কুল, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু বলছে ও মণীশ এদিকে এসো, উঠে এসো, দেখো দেখো তোমার জন্য ফলে ভরিয়ে রেখেছি। ছুটে গিয়ে উঠতে চেষ্টা করলেন কিন্তু না তার আগেই এক ভয় কাজ করছে, ভাবছেন যদি পড়ে যান। 

ওই যে, ওই কোণা থেকে বিল্টুর আওয়াজ শুনতে পেলেন "মণীশ.... এদিকে আয় দুজনে চিপ্পু খেলি খানিক।" ছুটে গিয়ে দেখলেন সেখানেও ফাঁকা। ধীরে ধীরে বিল্টুর বাসায় গিয়ে পৌঁছালেন, খবর পেলেন কিছুদিন আগে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা বিল্টু। 

মণীশের মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বেলা বয়ে যায় গঙ্গা কাকা ডাক দেয়। বাড়িতে ফিরে আসেন এবং অনেক গল্প চলতে থাকে। 

দুপুর বেলা ঘরটা গুমোট লাগায় জানালাগুলো খুলতে থাকেন। তার মধ্যে কিছু জানালা খুলতেই পাল্লাগুলা ভেঙে পড়ে যায়। মাকড়সার জাল বিছিয়েছে চারিদিক। গ্রীলগুলোতে হাত দিতেই ধুলোয় ভরে গেল।

 ব্যালকনিটার দরজা খুলতেই পাখির বাসা ধুপ করে মাথার উপর পড়ে। পায়রা তার ডানা দিয়ে ঝাপটা মেরে উড়ে যায়। 

বুঝতে পারলেন যত্নের প্রয়োজন ছিল শুধু তার বাড়ি নয় সংসারটাও। কখনও চাকরি সূত্রে ফিরে তাকাননি তার পরিবারের প্রতি। বুঝলেন বড় দেরি হয়ে গেছে তাই নতুন করে ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। জং ধরা জানালা দরজা নয় ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু প্রাণের পোষা ওই মরচে পড়া ভালোবাসার আর রিপেয়ারিং করা যাবে না।
আর্কাইভ