• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

ও মাইকেল, ও মধু

প্রকাশিত: এপ্রিল ৮, ২০২২, ০৪:১৬ পিএম

ও মাইকেল, ও মধু

আলমাস উদ্দীন আহমেদ

প্রিয় মধু, তোমার সাগরদাঁড়ী যাব-
      নয়ন ভরে দেখার বড় সাধ
      থাক না যতই লোকাচারের বাধ।
      তোমার জন্মস্থান দেখেনি ছেলে-মেয়ে
      রাজধানী কলকাতার জীবনটা একঘেয়ে;
এ কথা পাড়লে কী সাত-পাঁচ ভাবো?
অমনে বলো না হেনরিয়েটা-
      চলো ডার্লিং, যাই সাগরদাঁড়ী
      রাজনারায়ণ দত্তের প্রাসাদোপম বাড়ি;
      আসত সাত গাঁয়ের লোক
      শত দেখেও জুড়ায় না চোখ;
দত্ত বংশের পূর্বপুরুষের ভিটা।
কবি স্ত্রী-পু্ত্র-কন্যাসহ
      জন্মভূমি যশোরে এলেন
      ঘাটলা থেকে বজরা নিলেন।
      ছোট ছোট গ্রাম, গাছপালা-ঝাড়
      জলকে চলে বউ-ঝি নদীর পাড়;
নয়নাভিরাম বাংলার আবহ।
হারানো স্মৃতি ভাসে মানসপটে-
      শৈশব, প্রথম যৌবনের ছবি
      রোমন্থনে উদ্বেল মধু কবি।
      হঠাৎ মায়ের কোলে বজরার ছাদে
      দুধের শিশু মিল্টন কাঁদে;
হেনরিয়েটার বুক হু-হু করে ওঠে।
শর্মিও কাঁদে থেকে থেকে-
      কবির চোখে টলমল পানি
      ত্রিমোহনায় ভিড়ল বজরাখানি।
      আলস্টার, হ্যাট, হাতে ছড়ি
      গ্রামবাসী পালায় পড়ি-মরি;
মধুকে গাঁয়ের পথে দেখে।
মধুও ওদের দেখে হতবিহ্বল-
      নীল অত্যাচারের কাটেনিকো রেশ
      দেখে তারা ভীত সেই সাহেবি বেশ।
      কবির বুলি: পরেছিস ঠুলি? নইকো ল্যাঠা
      এই দ্যাখ- রাজনারায়ণের ব্যাটা;
চিনলি না আমাকে- মূর্খের দল!
ভণিতা রেখে মিনতি মধু’র-
      জমিদারের নাতির ক্ষিদেয় প্রাণ যায়
      আছে কার- শিগগির দুধ নিয়ে আয়।
      ওরা বলে- ক্ষমা কত্তা, বুঝিনি আগে
      ঘড়া ঘড়া দুধ দেব যদি তাও লাগে;
সবার মুখে সম্প্রীতির সুর।
বজরা এগিয়ে যায় সাগরদাঁড়ী-
      স্মৃতিতে ফেরে শেখপুরার মৌলবি
      শৈশবের রামলাল, মাতা জাহ্নবী;
      চণ্ডীমণ্ডপ, বাদামতরুর ঘাট
      ভাঙা শিবমন্দির, চিরচেনা মাঠ
আনন্দে অশ্রুর বাঁধ দিল ছাড়ি।
ধীর পায়ে আগুয়ান ধরতে বাড়ি-
      অজানা আবেশে নিশ্চুপ মধু
      আবেগে উচ্ছ্বসিত বিদেশিনী বধূ;
      পোয়েট, ইউ স্কিল ব্লুমিং দ্য আর্ট
      ইউর জেসর ক্যাপচার মাই হার্ট;
আই লাভ দ্য ভিলেজ সাগরদাঁড়ী।
পুকুরঘাটে আমতলায় পৌঁছালে চারজনা
      আনন্দমোহন চেঁচিয়ে পাড়া মাত
      মহিলারা হাসে- বৌ বিদেশি জাত!
      বৌমার প্রণাম নিল না বিমাতা
      জাত যাবে ছুঁলে, হারাবে শুচিতা;
নেই সিঁদুর-শঙ্খবাদন-উলুধ্বনি অর্চনা।
প্রসন্নময়ী বলে মুখ করে ভারি-
      খেতে দে আনন্দ- কলার পাতায়
      ঘরেতে যেন ওরা পা না বাড়ায়।
      হেনরিয়েটা স্বামীর বাহু ধরে বিস্মিত
      হতবাক মধু মুখ খোলেন স্মিত :
অথচ এ প্রাসাদটা আমারি।
উঠোনে বসেই মধুর আহার সেরে-
      নিজেই পাতা তুলে পুকুরে মুখ ধোয়া
      বাহির বাড়িতে দিন কয়েক শোয়া।
      নিত্য খানাপিনা মুসলমানপাড়া
      ছেলেদের কোলে তুলে বলেন : দাঁড়া
এঁটো খাইয়ে তোদের দি’ জাত মেরে।
হঠাৎ বংশীধর ঘোষের কথা ঢুকল মাথায়
      মধুর মামাবাড়ি কাটিপাড়া রাড়ূলী
      এ বিদ্যাধরের কাছে জাত-পাত মামুলি।
      ভাগ্নের পরিতাপ অবহিত খুঁটিনাটি
      সিন্দুক খুলে দিলেন সোনার থালাবাটি;
মামার অগোচরে আপ্যায়ন কলার পাতায়।
তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফের সাগরদাঁড়ী-
      স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের স্বাস্থ্য গেছে ভুলে
      দুপুর-বিকেল কাটে কপোতাক্ষের কূলে :
      তোমার তীরে পাতার কুটিরবাসীও সুখী
      যেও না ভুলে- আমি মধুসূদন দুখী।
কপোতাক্ষই ঠিকানা- আমার বাড়ি।
মধুসূদন, হেনরিয়েটা, শর্মি ও মিল্টন
      সমস্বরে হস্তজোড়ে দৃষ্টি মেলে দূর :
      তুমি গাঁয়ের মানুষেরে দিও মনে সুর।
      অসুর মনে পঙ্কিলতা লালন করে যারা
      তাদের পবিত্র করো- হে যশোর-জলধারা;
প্রিয় কপোতাক্ষের কাছে ছোট্ট নিবেদন।
আর্কাইভ