আলমাস উদ্দীন আহমেদ
প্রিয় মধু, তোমার সাগরদাঁড়ী যাব-
নয়ন ভরে দেখার বড় সাধ
থাক না যতই লোকাচারের বাধ।
তোমার জন্মস্থান দেখেনি ছেলে-মেয়ে
রাজধানী কলকাতার জীবনটা একঘেয়ে;
এ কথা পাড়লে কী সাত-পাঁচ ভাবো?
অমনে বলো না হেনরিয়েটা-
চলো ডার্লিং, যাই সাগরদাঁড়ী
রাজনারায়ণ দত্তের প্রাসাদোপম বাড়ি;
আসত সাত গাঁয়ের লোক
শত দেখেও জুড়ায় না চোখ;
দত্ত বংশের পূর্বপুরুষের ভিটা।
কবি স্ত্রী-পু্ত্র-কন্যাসহ
জন্মভূমি যশোরে এলেন
ঘাটলা থেকে বজরা নিলেন।
ছোট ছোট গ্রাম, গাছপালা-ঝাড়
জলকে চলে বউ-ঝি নদীর পাড়;
নয়নাভিরাম বাংলার আবহ।
হারানো স্মৃতি ভাসে মানসপটে-
শৈশব, প্রথম যৌবনের ছবি
রোমন্থনে উদ্বেল মধু কবি।
হঠাৎ মায়ের কোলে বজরার ছাদে
দুধের শিশু মিল্টন কাঁদে;
হেনরিয়েটার বুক হু-হু করে ওঠে।
শর্মিও কাঁদে থেকে থেকে-
কবির চোখে টলমল পানি
ত্রিমোহনায় ভিড়ল বজরাখানি।
আলস্টার, হ্যাট, হাতে ছড়ি
গ্রামবাসী পালায় পড়ি-মরি;
মধুকে গাঁয়ের পথে দেখে।
মধুও ওদের দেখে হতবিহ্বল-
নীল অত্যাচারের কাটেনিকো রেশ
দেখে তারা ভীত সেই সাহেবি বেশ।
কবির বুলি: পরেছিস ঠুলি? নইকো ল্যাঠা
এই দ্যাখ- রাজনারায়ণের ব্যাটা;
চিনলি না আমাকে- মূর্খের দল!
ভণিতা রেখে মিনতি মধু’র-
জমিদারের নাতির ক্ষিদেয় প্রাণ যায়
আছে কার- শিগগির দুধ নিয়ে আয়।
ওরা বলে- ক্ষমা কত্তা, বুঝিনি আগে
ঘড়া ঘড়া দুধ দেব যদি তাও লাগে;
সবার মুখে সম্প্রীতির সুর।
বজরা এগিয়ে যায় সাগরদাঁড়ী-
স্মৃতিতে ফেরে শেখপুরার মৌলবি
শৈশবের রামলাল, মাতা জাহ্নবী;
চণ্ডীমণ্ডপ, বাদামতরুর ঘাট
ভাঙা শিবমন্দির, চিরচেনা মাঠ
আনন্দে অশ্রুর বাঁধ দিল ছাড়ি।
ধীর পায়ে আগুয়ান ধরতে বাড়ি-
অজানা আবেশে নিশ্চুপ মধু
আবেগে উচ্ছ্বসিত বিদেশিনী বধূ;
পোয়েট, ইউ স্কিল ব্লুমিং দ্য আর্ট
ইউর জেসর ক্যাপচার মাই হার্ট;
আই লাভ দ্য ভিলেজ সাগরদাঁড়ী।
পুকুরঘাটে আমতলায় পৌঁছালে চারজনা
আনন্দমোহন চেঁচিয়ে পাড়া মাত
মহিলারা হাসে- বৌ বিদেশি জাত!
বৌমার প্রণাম নিল না বিমাতা
জাত যাবে ছুঁলে, হারাবে শুচিতা;
নেই সিঁদুর-শঙ্খবাদন-উলুধ্বনি অর্চনা।
প্রসন্নময়ী বলে মুখ করে ভারি-
খেতে দে আনন্দ- কলার পাতায়
ঘরেতে যেন ওরা পা না বাড়ায়।
হেনরিয়েটা স্বামীর বাহু ধরে বিস্মিত
হতবাক মধু মুখ খোলেন স্মিত :
অথচ এ প্রাসাদটা আমারি।
উঠোনে বসেই মধুর আহার সেরে-
নিজেই পাতা তুলে পুকুরে মুখ ধোয়া
বাহির বাড়িতে দিন কয়েক শোয়া।
নিত্য খানাপিনা মুসলমানপাড়া
ছেলেদের কোলে তুলে বলেন : দাঁড়া
এঁটো খাইয়ে তোদের দি’ জাত মেরে।
হঠাৎ বংশীধর ঘোষের কথা ঢুকল মাথায়
মধুর মামাবাড়ি কাটিপাড়া রাড়ূলী
এ বিদ্যাধরের কাছে জাত-পাত মামুলি।
ভাগ্নের পরিতাপ অবহিত খুঁটিনাটি
সিন্দুক খুলে দিলেন সোনার থালাবাটি;
মামার অগোচরে আপ্যায়ন কলার পাতায়।
তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফের সাগরদাঁড়ী-
স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের স্বাস্থ্য গেছে ভুলে
দুপুর-বিকেল কাটে কপোতাক্ষের কূলে :
তোমার তীরে পাতার কুটিরবাসীও সুখী
যেও না ভুলে- আমি মধুসূদন দুখী।
কপোতাক্ষই ঠিকানা- আমার বাড়ি।
মধুসূদন, হেনরিয়েটা, শর্মি ও মিল্টন
সমস্বরে হস্তজোড়ে দৃষ্টি মেলে দূর :
তুমি গাঁয়ের মানুষেরে দিও মনে সুর।
অসুর মনে পঙ্কিলতা লালন করে যারা
তাদের পবিত্র করো- হে যশোর-জলধারা;
প্রিয় কপোতাক্ষের কাছে ছোট্ট নিবেদন।
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন