পুতুল জেসমিন
যেদিন আমার ষাট বছর পূর্ণ হলো, সেদিন আমার হাত দুটিকে মনে হলো নরম পালকে আচ্ছাদিত পাখির ডানা।
আমি আকাশে সে ডানা মেলে দিয়ে
ইচ্ছেমতো উড়তে লাগলেম। এখন আমার ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজে ছুটতে হবে না। কোথাও কোনও ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে আমি আবদ্ধ নই।
কারুর কাছে আমার কাজের জন্য
কোনও জবাবদিহিতা নেই। আমার খেয়াল খুশিমতো আমি ঘুমাবো, হাসবো, বেড়াবো।
আমার ইচ্ছের ডানা ফিরে ফিরে চায়
আমার দূরন্ত উল্লাসে মেতে ওঠা শৈশবে, কৈশোরে এবং তারুণ্যের শুরুতে। এই সময়গুলোতে আমার কোনও কষ্ট ছিল না।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলে, নেচে, গেয়ে একবুক আনন্দ কুড়িয়ে সাঁঝ বেলা বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনিকে আরও মধুর মনে হতো।
আহা! মায়ের মুখের বকুনি আবার যদি একবার খেতে পারতেম!!!
ইচ্ছে করে সম্পূর্ণ বাংলাদেশ একবার
ঘুরে দেখি।
ইচ্ছে করে সেই আগের মতো মন খারাপের দিনগুলোতে *রাত্রির* *ঠিকানায়* গিয়ে হাজারটা শাড়ির মাঝে দেই এক ডুব!!
তারপর পছন্দের সবগুলি শাড়ি এনে
নতুন শাড়ির গন্ধ আকণ্ঠ পান করি!!
নতুন বইয়ের গন্ধ আমার ভালো লাগে
ইচ্ছে করে *পড়ুয়া লাইব্রেরি* গিয়ে
সবগুলো পছন্দের বই কিনি।
রাতদিন, নাওয়া খাওয়া ভুলে শুধুই বই
পড়ি!!
ছোট বেলার মতো নীলফামারীর
ডাকবাংলো রোডের মহুয়ার বনে গিয়ে
মহুয়া ফুলের সুঘ্রানে মাতাল হয়ে যাই!! শিরীষ পাতার ঝিরিঝিরি নূপুর বাজার সঙ্গে নিজেও ছন্দায়িত হই ঠিক আগের মতো।
দুপুর বেলায় মায়ের বিশ্রামের সময়
চুপি চুপি পালিয়ে বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াই ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে!!
কখনও ইচ্ছে করে বসে থাকি পা ডুবিয়ে টলটলে কোনও নদীর জলে।
আবার কখনও বা দাঁড়িয়ে থাকি
ছবির মতন একলা তরু তলে!
ইচ্ছে করে নিশুতি রাতের নীরবতায়
তানপুরাটা নিয়ে একটা দুটো, তিনটে...
গানের পরে গান গেয়ে যাই।
বেহাগ, দরবারি গাইতে গাইতে
ভৈরবীতে এসে থেমে যাই। আমার গান
শুনে প্রিয়হারা পাপিয়ার *পিউকাঁহা*
ডাক শুনতে পাই আমি।
আমার গানের সুরে লিচু গাছের দোয়েলগুলি ডানা ঝাপটা দিয়ে চুপচাপ দরজায় বসে বসে গান শোনে!
গান শেষ হলে ফিরে যায় নীড়ে।
ইচ্ছে করে বিকেলে ছাদে গিয়ে বুলবুলিদের রঙ্গ তামাশা দেখতে!
নেশা জাগানো অপূর্ব সুরের গান শুনতে!!
ইচ্ছে করে ছবি আপার সঙ্গে ছোট
বেলার ঘটে যাওয়া ঘটনার গল্প করতে!!
ইচ্ছে করে আহসান হাবিব কোহিনূর
ভাইয়ের তবলার সঙ্গ আবার নাচ
শিখতে। নাচতে নাচতে ভুল হলে
কোহিনূর ভাইয়ের স্নেহের পিটুনি
খেতে!!
ইচ্ছে করে ছোট বেলার সেই খুলনা মেইল-রকেটে (ট্রেন) চেপে নীলফামারী থেকে ছন্দে ছন্দে
সো... জা খুলনা যেতে!! তারপর
রূপসা নদীর ফটিক জল দেখতে!! বঙ্গোপসাগরের নীল নোনা জলের তীরে দাঁড়িয়ে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করতে!!
কতো কতো বিচিত্র ইচ্ছেরা ভর করে
আমার এই অবাধ্য মনে।
এখন আমার অবাধ্য হতেই ভালো লাগে!!
আমি যে এখন ষাট উত্তীর্ণ এক মানবী!!
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন