• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

দত্তক

প্রকাশিত: এপ্রিল ৫, ২০২২, ০৮:২৪ পিএম

দত্তক

অ্যানি সেন

শান্তিনিকেতন বৃদ্ধাশ্রমের অফিস  ঘরে আশ্রমের প্রধান কণিকাদির মুখোমুখি বসে আছে সপ্তর্ষি, লাবণ্য আর একপাশে পঞ্চাশোর্ধ্ব সংযুক্তা দেবী। কণিকাদি বললেন, 
‘সংযুক্তাদি, আপনি বললে তবেই আমরা এগোব। কেউ জোর করবে না আপনাকে। সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আপনার।‘ 

বরাবরের আত্মসম্মানী দৃঢ় ব্যক্তিত্বের মহিলাটি ছলছল চোখে তাকালেন লাবণ্য-সপ্তর্ষির দিকে। টেবিলের নিচে হাতে হাত ধরে, দমবন্ধ অবস্থায় বসে আছে ওরা। সংযুক্তা দেবীর ‘হ্যাঁ-না’তেই ওদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ভর করছে।

দুই 

দুই করপোরেট অফিসের জ্যোতির্ময় নক্ষত্র সপ্তর্ষি-লাবণ্য, নিজ নিজ ক্ষেত্রে ভীষণভাবে সফল। দুজনেই অফিসের তরফ থেকে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছে। একমাত্র ছেলে ঋজুকে এরকম ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার সুযোগ হয়তো আর আসবে না। যদিও দুজনে ভাবার সময় নিয়েছে।

ভাবনাটা হলো দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া ঋজুকে নিয়ে। গত ছমাসে চারবার গার্ডিয়ান কল হয়েছে ঋজুর স্কুল থেকে। এখন ’সৃজনশীল’, ‘অতি সক্রিয়’, অথবা ‘অন্যভাবে সক্রিয়’ শব্দগুলো ‘ভীষণ দুষ্টু’, ‘অস্থির’ বা ‘পড়াশোনায় অমনোযোগী’ কথাগুলোর নামান্তর মাত্র। প্রত্যেকবার ভদ্রভাবে এগুলো বোঝাতে বোঝাতে শেষবার সরাসরি ওদের দিকে অভিযোগ আনলেন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম।

তিন 

অফিসিয়াল কাজের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজও করে আইটি সেক্টরের বড় বড় করপোরেট অফিসগুলো। এমনই এক সংযোগে আলাপ হয়েছিল সপ্তর্ষি, লাবণ্যর। সেই আলাপ, ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রেমে বদলাতে বেশি সময় নেয়নি। বড় ঘরের ছেলে সপ্তর্ষির বাবা মেনে নেননি, অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মেয়ে লাবণ্যর সঙ্গে এই সম্পর্কটা। এক কথায় বাড়ি ছেড়ে চলে এসে আনাথ লাবণ্যকে সম্পর্কে বেঁধেছিল সপ্তর্ষি। ভালোবাসার ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে গিয়েছিল দুজনে। সেই ঝোড়ো হাওয়ায় ভালোবাসার একটা টুকরো ’ঋজু’ এসে পড়েছিল ওদের কোলে।

সংসারে সুখ, আনন্দের ঘাটতি না থাকলেও সপ্তর্ষিকে পরিবারের থেকে দূরে করার অপরাধবোধ সবসময় কাজ করত লাবণ্যর মধ্যে। শুধু তাই নয়, সপ্তর্ষির বাবা-মায়ের মধ্যে নিজেরও বাবা-মাকে পাওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল লাবণ্যর। সেজন্য বারবার গিয়েছিল ওনাদের মানাতে। এমনকি ছোট্ট ঋজুকেও নিয়ে গিয়েছিল। নাতির মুখ না দেখেই সপ্তর্ষির জেদি বাবা অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ওদের। সপ্তর্ষির মায়ের চোখের জলের দামও দেননি ভদ্রলোক। সপ্তর্ষির জেদ তাতে আরও বেড়ে গিয়েছিল। সংকল্প নিয়েছিল, এ জীবনে আর ওই বাড়িতে পা দেবে না।

তার পরের সময়গুলো আরও ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল ওদের। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে একটা তিন কামরার ফ্ল্যাট, বাইকের পর একটা চারচাকা গাড়ি কেনার পাশাপাশি ঋজুকে আগলে রাখা, বড় করা, ভালো স্কুলে দেওয়ার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করছিল দুজনে। এতে বাকি সবকিছু মুষ্টিগত হলেও একমাত্র ছেলের ভাগে সময় কম পড়ে যাচ্ছিল। চেয়েও দুজনের কেউই সময় দিতে পারছিল না ছেলেকে। ফলস্বরূপ অবাধ্যতা, জেদ, জিনিসপত্র নষ্ট, নিত্যনতুন দামি খেলনার বাহানা, স্কুলে মারামারি, কথা না শোনা এবং পরিশেষে গার্ডিয়ান কল। পছন্দের খাবার, খেলনার জোগান বা নানা সৃজনাত্মক কাজ- যেমন আঁকা, কারাতে, তবলা, সাঁতার দেওয়া থেকে শুরু করে দুজন প্রাইভেট টিউটর রেখেও কোনো লাভ হয়নি। আবার এই বাজারে কোনো একজনের পক্ষে কাজ ছেড়ে বাড়িতে বসে ছেলে পালন করাও সম্ভব নয়। 

দুজনেরই বন্ধুমহল থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল আরেকটি সন্তান নেওয়ার। তাতে ঋজু সঙ্গী পাবে, ওর অতি সক্রিয়তা প্রকৃতপক্ষে সৃজনশীলতার রূপ নেবে, দায়িত্ব পেলে অস্থিরতাটাও কমবে, সচেতন হবে। একান্নবর্তী পরিবারগুলো তো এভাবেই চলে, সুখে-দুখে একসঙ্গে। 

আরেকটি সন্তান নেওয়া সম্ভব নয় ওদের পক্ষে। ঋজু হওয়ার সময় শারীরিক অবস্থার যথেষ্ট অবনতি ঘটেছিল লাবণ্যর। সেই সময়েই ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন, আরেকটি সন্তান লাবণ্যর জীবনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অতএব সেদিকে কোনোমতেই যাবে না সপ্তর্ষি। 

তাহলে আর একটিমাত্র উপায় হলো ‘দত্তক’। কিন্তু তার জন্যও কি প্রস্তুত ওরা? ফ্ল্যাটের ঋণ, চার চাকার ঋণ চলছে। শহরের নামকরা দামি স্কুলে পড়াতে প্রতি মাসে যে পরিমাণ টাকা ওদের খরচ হচ্ছে, তার ওপর ছেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা, সবকিছু ভেবে পিছিয়ে এসেছিল ওরা।
     
এরকমই টানাপোড়েন, দুশ্চিন্তায় দিন কাটছিল সপ্তর্ষি ও লাবণ্যর। সেই সময় লাবণ্যর অফিস থেকে আবার একটি সমাজসেবামূলক কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবারের গন্তব্য শান্তিনিকেতন বৃদ্ধাশ্রম। উদ্দেশ্য, পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকা ওখানকার মানুষদের সঙ্গে একটু সময় কাটানো, গল্প-হাসি-মজা করা, একটু খাওয়া-দাওয়া এবং ওনাদের একাকীত্বের ভাগ নেওয়া। সপ্তর্ষিও সঙ্গে গিয়েছিল লাবণ্যর ঋজুকে নিয়ে। এ ধরনের কাজে ওরা সর্বদা একে ওপরকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করে। 

দিনের শুরুটা বেশ ভালোভাবে হলেও উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে ঋজুর দুষ্টুমি। সমান তালে বাড়তে থাকে ওর উশৃঙ্খলতা। খাবার জিনিস নষ্ট, আশ্রমবাসীর জন্য আনা উপহারের প্যাকেটগুলো ছিঁড়ে ফেলা, তার সঙ্গে অবাধ্যতা। উঁচু পোস্টে কাজ করা লাবণ্যর মুখের সামনে কেউ কিছু না বললেও সবার বিরক্তিটা বেশ বুঝতে পারে ওরা। ভীষণ অপ্রস্তুতে পড়ে যায় দুজনে। দিনের পর দিন ছেলের নামে অভিযোগ শুনতে শুনতে আর এরকম বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হতে সহসা ধৈর্যচ্যুতি ঘটে সপ্তর্ষির। প্রচণ্ড রেগে, ছেলের খোঁজে এদিক সেদিক গিয়ে দেখে, বাগানে একপ্রান্তে কাদামাটি মেখে অপটু হাতে অসীম যত্নে একটা গাছের চারা লাগাতে ব্যস্ত সে। পাশে একজন বৃদ্ধা, দিদিমণির মতো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সমানে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন তাকে। একমনে সেই দৃশ্য দেখতে থাকে সপ্তর্ষি। কিছুক্ষণ পরে লাবণ্যও এসে দাঁড়ায় স্বামীর পাশে। দুজনে মিলে উপভোগ করতে থাকে দৃশ্যটি। 

গাছ লাগানো শেষ হলে বাবা মায়ের দিকে চোখ পড়ে ছোট ঋজুর। উৎফুল্ল হয়ে ছুটে আসে, কাদামাখা হাতে বাবা-মাকে ধরে টেনে নিয়ে যায় বাগানে।
-‘বাবা, মাম, দেখো আমি গাছ লাগিয়েছি।’ নতুন কিছু করার উল্লাসে টগমগ সে।

বৃদ্ধার কাছে গিয়ে সপ্তর্ষি বলে,
‘ম্যাডাম, আজ পর্যন্ত ওকে।

ডিআইএ

আর্কাইভ