কঙ্কনা ভট্টাচার্য্য
পালঙ্কটা বড় সুন্দর, ময়ূরপঙ্খী নাও যেন। বিন্দুবালা রোজ নিজের হাতে পালঙ্কটা মোছেন। আজও মুছছিলেন।
আজ এত বছর হয়ে গেল, তবুও পালঙ্কের জেল্লা এতটুকু কমেনি।
পালঙ্কটা বড় শখ করে তার বিয়েতে বাবা কন্যাকে যৌতুক দিয়েছিলেন।
প্রায় তিন মাস ধরে পালঙ্কটা তৈরি করেছিল মহিম ছুতোর।
বিন্দুবালার বয়স তখন পনেরো বছর। আজ তিনি সত্তরোর্ধ্ব নারী। গায়ের চামড়ায় টান ধরে কুঁচকে গেছে। তবু এখনও তাকে দেখে তার সেই পনেরো বছরের রূপকে কল্পনা করে নিতে কারও অসুবিধা হয় না।
আজ তার স্বামী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে এই পালঙ্কেই শুয়ে থাকেন।
সেদিনের সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ অমিতেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আজ নখদম্তহীন হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। এখন আর বলেন না, মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের মতো থাকো। বেশি বাড়াবাড়ি করতে যেও না। না হলে ঘাড় ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দেব।
বিন্দুবালার এখন করুণা হয় এই মানুষটার প্রতি।
মাঝে মাঝে মনে হয় ঠেলে পালঙ্ক থেকে ফেলে দেন। কিন্তু ওই যে তিনি স্ত্রী, স্বামী নন। তাই ইচ্ছেটাকে গিলে নিতে হয়।
পালঙ্কটা মুছতে গিয়ে তার হঠাৎ মনে হলো, দেখি তো নাম দুটো দেখা যায় কিনা।
আগে তো প্রায়ই দেখতেন আর হাত বুলোতেন, এখন চোখে লেন্স থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টিশক্তি ক্রমেই কমছে।
তাই দুপাশের আলো দুটোই জ্বালিয়ে দিলেন।
পালঙ্ক মোছার ঝাড়নটা যেখানে থাকে, সেখানটায় হাত দিলেন দুটো নাম নীল ও বিন্দু।
বড় মমতায় বড় ভালেবাসায় হাত বুলোলেন খোদাই করা নাম দুটোর ওপর। দুফোঁটা চোখের জল বুঝি বা ফেললেন।
নীল নীলেশ ছিল তার নাম। কতই বা বয়স হবে সেই সময়। আঠারো কি উনিশ ছিল বোধহয়। পুব পাড়ার মহিম ছুতোরের ছেলে। বাবার সঙ্গে কাঠের কাজ করতে সে বিন্দুর বাপের বাড়িতে এসেছিল।
বিন্দু ঘরের মধ্যে আর নীল বাইরে, তবু কী করে প্রথম দরশনেই দুজনের বুকে দোলা লেগেছিল কে জানে।
একটু একটু করে কাছে আসতে আসতে কখন যে নীলের প্রতি তার আর তার প্রতি নীলের একটা বিচিত্র অনুভূতির জায়গা তৈরি হয়েছিল, তা দুজনের কেউই বুঝতে পারেননি।
নীল পালঙ্কর ডিজাইন করতে গিয়ে তার আর নীলের নাম খোদাই করেছিল ওই পালঙ্কে। কেউ বুঝতে পারেনি। অবশ্য কেউ বলে না দিলে ময়ূরপঙ্খীর ময়ূরের পেখমের মধ্যে থাকা ওই নাম কারও পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।
একেবারে কালো কষ্টি পাথরে কোঁদা শরীর, খাড়া নাক আর ঘন পল্লবে ঢাকা দুটি অতলান্ত মায়া মাখানো চোখ। তার ওপরে ধনুকের মত বাঁকা ভ্রু।
একমাথা কোঁকড়ানো চুল।
বাটালি আর ছেনি নিয়ে কাজ করার সময় তার শরীরের ওঠানামা এসব বসে বসে দেখত বিন্দু।
খুব ইচ্ছে করত ওই ঘন চুলগুলো নেড়ে দিতে।
নীলেশ কাজ করত আর হাসত।
একটা মুগ্ধতার ঘোর ফুটে উঠত দুজনের চোখে।
একদিন নীলেশ প্রথম কথা বলল বিন্দুর সঙ্গে, আহ্, কী সুন্দর কণ্ঠস্বর।
সবে কলি থেকে কুসুম হয়ে ফুটে ওঠার বয়স বিন্দুর, সে প্রথম উপলব্ধি করল। একেই বোধহয় ভালোবাসা বলে।
ওই কদিনের নীলেশের উপস্থিতি তার জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখার রসদ জোগাবে, এ কথা বোধহয় বিন্দু স্বপ্নেও ভাবেনি।
শুধু একবার মাত্র একবার নীলেশ তার ওষ্ঠ স্পর্শ করেছিল।
তার সেই শক্ত অথচ মায়াভরা হাতের স্পর্শ এখনও বিন্দুর ওষ্ঠে লেগে আছে।
তারপর দশ বছরের বড় এই অমিতেন্দ্রর সঙ্গে তার শুভ পরিণয়। নীলেশের তৈরি করা পালঙ্কে তার কৌমার্যকে ছিঁড়ে খুঁড়ে তার মনকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে এই লোকটা তাকে ঘুণপোকার মতো কেটেছে।
তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে সারা জীবন ধরে। আর যতবার সে এই লোকটার কাছ থেকে আঘাত পেয়েছে, ততবার সে এই পালঙ্কের কাছে এসে সান্ত্বনা খুঁজেছে।
এ যেন কাঠের তৈরি শুধু পালঙ্ক নয়, রক্তমাংসে গড়া ঊনিশের সেই নীলেশ। এই পালঙ্কে খোদাই করা ওই নাম দুটোর ওপরে হাত বুলোলেই এই সত্তরোর্ধ্ব বিন্দুবালা পঞ্চদশীতে পরিণত হয়।
আর পালঙ্কে শুয়ে থাকা ওই মানুষটাকে তার একটা রক্তচোষা জোঁকের মতো মনে হয়। যে সারা জীবন ধরে তার শরীরের রক্ত শুষে খেল আর বিন্দু এই সমাজের ভয়ে, লোকলজ্জার ভয়ে তাকে নুন দিয়ে গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না।
ডিআইএ/এফএ
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন