প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
বছরে তিন-চারবার রেসকোর্স যেতাম, আর গেলে মেম্বার্স এনক্লোজারেই ঢুকতাম। এক বন্ধু সেদিন আমার সাথে প্রথমবার গিয়েছিল। আমরা মনের আনন্দে ঘোড়া দেখছি, রেস দেখছি। হঠাৎ দেখি আমার বন্ধুটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আমি গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- ‘কী হলো, লুকাবার কী আছে?’
আমার বন্ধুটি বলল, 'ওই যে ভদ্রলোক হাতে লাঠি, আমার বাবার স্কুলের বন্ধু। আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই আসেন বাবার সাথে গল্প করতে। এখানে দেখলেই বাবাকে বলে দেবেন।’
আমি, 'ওহ এই ব্যাপার। এটা কোনো সমস্যাই নয়। যা গিয়ে বোল্ডলি কথা বল তার সাথে। দেখবি তোর বাবাকে উনি তোর কথা বললেও অন্যভাবে বলবেন। আমার কথা শোনরে।’
বন্ধুটি কিছুটা ইতস্তত করে দেখা করল। কিছুক্ষণ কথাও বলল।
একটা রেসে ওর বাবার সেই বন্ধু ওকে একটা ঘোড়ার টিপস দিলেন। সেটা জিতলও। দিন দশেক বাদে বন্ধু জানাল, ‘ওই কাকু বাবাকে বলেছেন আমার সাথে দেখা হয়েছিল। কিন্তু কোথায় দেখা হয়েছিল, বাবাকে বলেননি। থ্যাঙ্ক ইউ।’
আমি মনে মনে, 'হুঁ হুঁ, উনি তোর বাবাকে কোথায় দেখা হয়েছিল কোনোদিন বলবেনও না।’
আমাদের বাড়িতে ওর খুব আসা-যাওয়াতে আমার একমাত্র বোনের সাথে ওর প্রেমের সম্পর্ক হয়েছিল। ওরা দুজনে মাঝেমধ্যে ঘুরতেও যেত শহরের এখানে সেখানে। আমার মৃদু প্রশ্রয়ও ছিল। বোন স্কুলে চাকরিটা পাওয়ার পর বাবা ওকে বিয়ের কথা বলতে ও জানিয়ে দেয়, বিয়ে করলে শুধু অম্লানকেই করবে। সেই ছোটবেলার বন্ধুর নামই অম্লান।
বাবা এক সন্ধ্যায় অম্লানের বাবার কাছে গেলেন বিয়ের কথা বলতে। উনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন, আমাদের মতো চাকরিজীবী সাধারণ পরিবারে সাথে ওদের মতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক হয়নি, হবে না। বাবা জানিয়েছিলেন ওদের ১০ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্কে আছে। ওর বাবা উত্তরে জানিয়েছিলেন, 'আমার ছেলে প্রেম করবে নিজের ইচ্ছায় আর বিয়ে করবে আমার মতে।’ বাবা চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে চলে এসেছিলেন।
এই ঘটনার এক বছরের মধ্যে অম্লানের খুব জাঁকজমকের সঙ্গে তথাকথিত অভিজাত পরিবারে বিয়ে হয়েছিল। এতকিছুর পরও আমি আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হতে দিইনি।
মাত্র তিন দিন আমি ওকে রেসকোর্স নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম সেই বন্ধু পুরো রেসুরে/জুয়াড়ি হয়ে গেছে।
অভিজাত যৌথ পরিবার ওদের। একদিন সেই একান্নবর্তী পরিবারে ফাটল দেখা দিল। শরিকে শরিকে বিবাদ কলতলার ঝগড়ায় রূপ নিল। ওর শেয়ার যাতে ও ঠিকমতো পায়, তার জন্য নামিদামি উকিল ঠিক করে দিলাম। অনেকদিনের বন্ধু, আমার কর্তব্য ছিল এটা। এদিকে মামলায় পয়সা বেরিয়ে যাচ্ছে জলের মতো। ওদিকে রেসেও পকেট খালি হচ্ছে। আবার প্রতি সন্ধ্যায় দামি হুইস্কি খাওয়ার অভ্যাস। ক্রমে টাকার অভাব দেখা দিল। বউয়ের সোনা সব বেচা হয়ে গেল। এসব দেখে অম্লানের বউ ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
হতাশা থেকে ও মদ ধরল। সকাল থেকেই চালু হতো ড্রিংক করা। টাকার অভাবে বাংলা খাওয়া শুরু করল। ওদের পরিবারে কেউ কোনোদিন চাকরি করেনি। ভাড়ার টাকা, তিনটে ট্যাক্সির আয় আর শেয়ার বেচে সংসার চলেছে এতদিন। কোর্টকাছারির জন্য ভাড়া রেন্ট কন্ট্রোলে জমা পড়ছে। মামলার ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত টাকা ওরা পাবে না। অম্লান কোনোদিন চাকরির দিকে দেখেনি পর্যন্ত। ওর সম্ভ্রান্ত পরিবার বলে গর্বটা নোনা আর ড্যাম ধরা দেয়ালের সিমেন্টের মতো খসে পড়ছিল।
লিভার সিরোসিস হলো। বছরখানক বাদে ভগবানের প্রিয় হয়ে গেল। যেদিন ও মারা গেল, সেদিন দাহ কাজ সেরে বাড়ি ফিরে স্নানটান করে বউকে বললাম, আমাকে এক ঘন্টা একা ছেড়ে দিতে। বউ ভাবল, প্রিয় বন্ধু মারা গেছে, তাই একা থাকতে চাইছে। সে বলল, 'যাও আমাদের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে বসো গিয়ে। তুমি না বেরোনো পর্যন্ত কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না।’
আমাদের ঘরে গেলাম। এই ঘরে বোনের একটা ফটো বাঁধিয়ে রেখেছি। আমার ভীষণ প্রিয় আর আদরের ছিল ছোট বোন। দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। ওর ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে চোখ ভর্তি জল নিয়ে বললাম, ‘বাবার অপমান আর তোর ভালোবাসার অসম্মান সহ্য করতে না পেরে গায়ে আগুন দিয়ে তুই আত্মহত্যা করেছিলি। সেই আত্মহত্যার পুরো বদলা আজ নিলাম। বাবাও তোর মৃত্যুর পরে বেশিদিন আর বাঁচেননি।’
আমিও তোদের ব্যাপারটা নিয়ে বলেছিলাম ওকে। ওর উত্তর ছিল, ‘তোর নিজের বোন বলে বড় সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছিস। আরে ওসব ছিল টাইম পাস। বাবার কথা না শুনলে বাবা ত্যাজ্যপুত্র করে দেবেন। তখন খাব কী আর থাকব কোথায় বউ নিয়ে? তুই ব্যাপারটা ভুলে যা আর তোর বোনকেও বলিস ভুলে যেতে।’
সেদিনই অঙ্গীকার করলাম কিছু করার।
অম্লানকে প্রথম তিন দিন রেসে নিয়ে গিয়ে জুয়ার নেশা ধরিয়ে নিজে কেটে পড়েছিলাম। তারপর শরিকদের সাথে মামলায় দামি উকিল দিলাম। যে মামলা কোর্টের বাইরেই মিটিয়ে নেওয়া যেত, সেটা আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শটা আমিই দিয়েছিলাম, ওর ইগোটা হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে।
একটা পরিবারকে শেষ করার জন্য জুয়া আর উকিলই যথেষ্ট। তাও আমি কোনো চান্স নিতে চাইনি। যখন দামি হুইস্কি কেনার টাকা থাকত না ওর, তখন বাংলার বোতলটা আমি নিজেই কিনে দিতাম। তারপর তো এমন নেশায় পড়ে গেল যে, শেষে স্পিরিট খাওয়া ধরেছিল। লিভার সিরোসিসে ভুগে হাসপাতালের ফ্রি বেডে মরল। অম্লানের আশপাশে তখন আমরা কজন বন্ধু ছাড়া কেউ নেই।
এবার মনে হয় তোর আত্মা একটু শান্তি পাবে বোনু। যখন এই কথাগুলো বলছি, তখন দেয়ালে বাঁধানো ওর ফটোটা আমার চোখের জলে ঝাপসা হয়েও দেখা যাচ্ছে।
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন