পুতুল জেসমিন
নীলফামারীর মেয়ে গীতাদি।
অনিন্দ্য সুন্দরী । তিনি মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি। কিন্তু তিনি
মুক্তিযুদ্ধ করেছেন একটু অন্যভাবে।
গীতাদির যুদ্ধের কথাই আমি সবাইকে জানাতে চাই। (লিখেছেন গীতাদির ছোট ভাই শিশির চক্রবর্তী। তিনিও ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার ডায়েরি থেকে)
তিনি তার ডায়েরিতে লেখেন-
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ।
দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। আমাদের
প্রয়াত বড়দি গীতা চক্রবর্তী ভারতের নদীয়া জেলার
সীমান্ত-সংলগ্ন বিভিন্ন জায়গায় যেমন কৃষ্ণনগর, করিমপুর, তেহট্টা, পলাশী পাড়াসহ সীমান্তের বিস্তীর্ণ
এলাকায় সেবামূলক কাজ দিয়ে মহান মুক্তি সংগ্রামে
অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো মার্চ মাস থেকে।
জুন থেকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেল।
সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে শরণার্থীদের আর্তচিৎকার,
বাতাসে বারুদের গন্ধ। অন্যদিকে, যন্ত্রণায় মানুষের আর্তনাদ, মুক্তিযুদ্ধে সদস্যদের যারা আহত
হয়ে ভিড় জমিয়েছে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা,
সাতক্ষীরা এসব সীমান্ত পেরিয়ে নদীয়া জেলার বিস্তীর্ণ
অঞ্চলে, এরা সংখ্যায় শত শত। সে সময়ে আমার
বড়দি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই আহত মুক্তিযোদ্ধাদের
সেবা এবং সহযোগিতা করার জন্য। দিন-রাত এক করে, খেয়ে না খেয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন করিমপুর
থেকে কল্যাণীসহ নদীয়া জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
বাহিনীর সদস্যদের সুস্থ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরত
পাঠিয়েছেন হাসিমুখে । অতবড় দায়িত্ব পালন করতে
গিয়ে প্রতিবন্ধকতা, দুঃখ, কষ্ট, বন্ধুতা অতিক্রম করতে হয়েছে। কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে সে সময়ে
শত্রুর বুকে কাঁপন ধরাতে পারতেন একমাত্র
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। যারা বাংলায় আজও
অবহেলিত। মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেকের কথা লেখা হলেও
হয় না স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা। অথচ তারা মুক্তিযুদ্ধে
এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন স্বাধীন
বাংলাদেশ গড়ার। স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার। সে সময়ে বিভিন্ন সেক্টরে নিরলসভাবে কাজ করে গিয়েছেন। বড়দিদের তেমনই একটা
গ্রুপ ছিল। ওই সময় কোনো এক ক্লিনিকের পাশে
দাঁড়িয়ে বড়দি একটা ছবি তুলেছিলেন, ছবিটা পাঠিয়ে দিলাম। (যে ছবিটা আমি দিয়েছি)
বড়দি কীভাবে সীমান্তে গেলেন?
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে নীলফামারী শহরটাকে পুরোপুরি কব্জা করে নিলো।
সে সময় শহরের মানুষ রিক্ত নিঃস্ব হয়ে সব ফেলে দলে দলে গ্রামে পাড়ি জমাতে লাগল প্রাণের ভয়ে। শুধু
রাজাকার, আলবদররা রয়ে গেল।
আমরাও চলে গেলাম শহর ছেড়ে নীলফামারীর
অদূরে রামনগর গ্রামে। আমীনুরদের বাড়ি হলো
আশ্রয়স্থল। আমরা ১৫-১৬ দিন সেখানে থেকে
রওনা দিলাম ভারতের উদ্দেশে। রামনগর থাকাকালীন আমি দু-তিনবার নীলফামারী শহরে এসেছিলাম।
আমি তখন স্বচক্ষে দেখেছি পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডব। দোকান ভেঙে মালপত্র বের করে মানুষকে
গুলি করে হত্যা করে লুকিয়ে রেখেছে। ভারতের পথে
যাওয়ার সময় অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে দুর্গম পথে কখনও হেঁটে তিন-চার দিন পর উপনীত হই
কোচবিহারের সীমান্ত গ্রাম দেওয়ানগঞ্জে। এখানেই
আমরা আশ্রয় নিই। আমরা কখনও জলপাইগুড়ির কোনো শিবির কিংবা আশ্রয়স্থলে ছিলাম না।
আমার বিচরণ ছিল ৬ নম্বর সেক্টরে। আমার
ছোট ভাই শ্যামল চক্রবর্তী। ও ছিল হলদিবাড়িতে।
আর্তপীড়িত অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী
বিলি করে নিজেকে শামিল করেছিল দেশসেবার
কাজে। শরণার্থীদের সহযোগিতা করাই ছিল ওর কাজ।
এভাবে শ্যামলও দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ
নিয়েছিল। দেওয়ানগঞ্জ থাকাকালীন আমি
বড়দিকে নিয়ে চলে যাই কলকাতায়। সেখানে বড়দিকে
মাসি ও মেসোর কাছে রাখি। মেসোমশাই তখন
কলকাতার নার্সিং হোমের ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত।
ওনার নার্সিং হোমের পাশে ছিল ঋষি অরবিন্দের আশ্রম। সেই আশ্রম বাড়িটাই ছিল সেই সময়ে
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বাংলাদেশের অনেক মন্ত্রী, নেতার যাওয়া-আসা ছিল সেখানে। সংগীত
জগতের রথীন্দ্রনাথ রায়, আপেল মাহমুদ,
গোবিন্দ হালদারসহ দু'দেশের শিল্পীদের পদচারণা।
সেই সুবাদে মেসোর সঙ্গে পরিচয় হয় অনেকের। উনি
বাংলাদেশের কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিছু ডাক্তার ও নার্স বড়দিকে নিয়ে যায়
কল্যাণীতে। কল্যাণীতে অস্থায়ী, ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক,
হাসপাতালে নিয়োজিত হন বড়দি। বড়দির নার্সিং
ট্রেনিং দেওয়া আগেই ছিল। তখন ওই সীমান্তে
বাতাসে বারুদের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। মানুষের হাহাকার,
আর্তনাদ, চিৎকারে ভারী বাতাস।
ওপারে যশোরে প্রচণ্ড লড়াই। বড়দি ঝাঁপিয়ে পড়েন
মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষায়। জুলাই ১৯৭১ থেকে
ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন।
কলকাতায় ফেরেননি।
স্বাধীনতা লাভের পর চলে আসেন যশোর কমান্ড
হাসপাতালে। সেখানে ১৯৭২ সালের
জানুয়ারি অবধি বিশেষ ট্রেনে করে চলে আসেন
লাল-সবুজের পতাকা শোভিত নতুন দেশ-
বাংলাদেশের প্রিয় জন্মস্থান নীলফামারীতে। আবার সেই সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।
এরপর একদিন চির ঘুমের দেশে চলে গেলেন গীতাদি।
শরীরটাতে কত আর ধকল সইবে! বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে যায় বড়দি গীতা চক্রবর্তীর নাম,
এত ত্যাগ! দেশের মানুষ দেশের স্বার্থের জন্য!
নিঃস্বার্থ যুদ্ধ, সবাই ভুলে গেলেও আমরা কখনও ভুলব না দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বড়দির অবদান।
বড়দি শুধু দিয়েই গেছেন। বিনিময়ে পাননি কিছু।
দেশের কাছ থেকে তার পাওয়ার তো অনেক কিছুই ছিল। পাননি সামান্য সম্মানটুকু! পরবর্তী প্রজন্ম
জানবে না বড়দির ব্যথা ভরা ইতিহাস!
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন