• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

অনেকটাই বদলে গেছ

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২২, ০৯:০৫ পিএম

অনেকটাই বদলে গেছ

চিত্রা কুণ্ডু বারিক

মা...
চিৎকার করে উঠল পিউ। তখন ঘুমে ছিল সে। ওই সময় তার চোখে কয়েক ফোঁটা জল স্থির ছিল।  খাটের এক কোণায় একা  শুয়ে আছে। পিউর বয়স বছর সাতেক হবে। তাই তার শোবার চার পাশে বালিশ দিয়ে দেয়াল দেয়া হয়েছে। 

পিউর বাবা গতকাল রাতে নতুন বউ নিয়ে ফুলশয্যায় ব্যস্ত । তার মন নেই পিউর মায়ের দিকে।

পিউর মা একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী। মাঝে মাঝে হসপিটালে ভর্তি হন । মাথার ভেতর জল জমে ভীষণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। নিরুপায় হাসপাতাল ছাড়া পথ থাকে না। এই বোঝা টানতে নারাজ পিউর বাবা।

মেয়েকেও দিনের পর দিন অসহ্য লাগছিল। পিউর মা বাড়িতে থাকাকালীন সবটাই বুঝতে পারছিলেন। এটাও বুঝতে পারছিলেন যে, তাকে ছাড়তে পারলেই বাঁচেন। কিন্তু মুখে কিছু বলতেন না। একদিন পিউর বাবা তার মায়ের ওপর রাগ দেখিয়ে মেয়েকে ভীষণভাবে পেটালেন। ওইটুকু মেয়ে সে মারের আঘাত মুখ বুজে সহ্য করে। কারণ, সে জানত এটুকু সহ্য না করলে তার মায়ের ওপর নির্যাতন চলবে। কিন্তু মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। পরদিনই আবার ভর্তি হন হসপিটালে। নার্সদের বলতে থাকেন- ও নার্স দিদি, আমি সত্যিই কখনও আর সুস্থ হবো না? দেখো না আমার ওই একরত্তি মেয়ে কতকিছু মুখ বুজে সহ্য করে। আমি বাঁচলে ওকে নিয়ে অনেক দূর চলে যাব। ওর বাবা যা ইচ্ছা করে করুক। আমি এবং আমার মেয়ে ওই জানোয়ারের হাত থেকে রেহাই পাবো। এ বলেই কাঁদতে লাগলেন। চোখের জল তখন গড়িয়ে পড়ছে দু'গাল বেয়ে।

জানেন দিদি, জন্ম থেকে আমার কারণে মেয়েটা বাবার আদর-ভালোবাসা পায়নি। কী যে মরণ রোগ হলো আমার। দূর থেকে ডাক্তার বাবুও শুনছিলেন পিউর মায়ের কষ্টের কথা। ডাক্তার বাবুও সন্তানহারা ছিলেন। তাই তিনিও নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। এক সময় ডাক্তার বাবু আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ডাক্তার বাবু জানেন পিউর মাকে কিছুতেই  সুস্থ করে তোলা যাবে না। তার তো জীবন মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। 

গভীর রাতে হসপিটালে কেউ নেই। সব পেশেন্ট ঘুমে। নার্সদের আনাগোনা কম। ঠিক সেই সময় ডাক্তার বাবু পিউর মায়ের কাছে এলেন। বললেন, আপনি এখনও ঘুমোননি?

পিউর মা তখন আনমনা হয়ে দেখলেন। বললেন, ঘুমোয়নি। ডাক্তার বাবু তার মাথায় হাত রেখে বললেন, আমি একটা আবেদন করতে পারি? পিউর মা অবাক হয়ে বললেন, ডাক্তার বাবু আমার তো শেষ সময়, আপনার আর্জি কি পূরণ করতে পারব? বলুন আমি শুনব!

আপনার.... বলতে গলা আটকে যাচ্ছে, কীভাবে শুরু করবেন তিনি বুঝতে পারছেন না। পিউর মা বললেন, কোনো দ্বিধা বোধ করবেন না, বলুন প্লিজ আমাকে। এটাই বলবেন তো, ডাক্তার বাবু আপনি পারবেন আমাকে সুস্থ করে মেয়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে! বলেই কেঁদে ফেলেন পিউর মা। জানি, আমি জানি একমাত্র আপনিই পারেন আমার মেয়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে।

ডাক্তার বাবু চুপ করে থাকেন। চোখ দুটি লাল হয়ে যায়। নিজেকে অত্যন্ত শক্ত করে পিউর মায়ের হাত দুটো ধরে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। পিউর মা শান্ত হন। ডাক্তার বাবু এবার বলেন, আপনার মেয়ের দায়িত্ব আমাকে দেবেন? মেয়ের সঙ্গে আপনার সমস্ত দায়ভারও নিতে চাই। শুধু একটু ভালো থাকার জন্য। এই অনুরোধ ফিরিয়ে দেবেন না ।

আমি রাজি। আপনি এখনই আমার কাছে আমার মেয়েকে এনে দেবেন ডাক্তার বাবু? একসঙ্গে মা ও মেয়ে আপনার কাছে চলে যেতে চাই।

ডাক্তার বাবু শুধু বললেন, শুনুন আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন না। আমি এখনই যাচ্ছি মেয়েকে নিয়ে আসতে। জেগে থাকুন, যতই কষ্ট হোক, কিন্তু ঘুমোবেন না। আমি আসছি, এখনই যাব আর আসব। 

অপেক্ষা না করে চলে গেলেন মেয়েকে আনতে। প্রায় ভোরের আগমন। মেয়েকে নিয়ে এলেন তার মায়ের কাছে। মা তখনও চেয়ে আছেন মেয়েকে দেখার জন্য। চোখ টেনে আসছে, কিন্তু না তিনি মেয়েকে দেখবেনই। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে মেয়ে দৌড়ে আসছে মায়ের কাছে, আর মা... দুটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মেয়েকে অনুভব করবেন। মেয়ে ও ছুটে আসছে মায়ের গলা জড়িয়ে বলবে- এই তো "মা"... আমি এসেছি। কাছে আসতেই মেয়ে মাকে সারা মুখজুড়ে চুম্বন করে ভরিয়ে দেয়। আর বলে- "মা"... চলো আমরা আবার একসঙ্গে থাকব, ওঠো "মা"। "মা" বলে ওঠেন, হ্যাঁ রে "মা" চল আজ থেকে তোর আর আমার নতুন ঠিকানা। এই বলে ডাক্তার বাবুর হাতে মেয়ের এক হাত ধরিয়ে অন্য হাত নিজে শক্ত করে ধরে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়েন চিরতরে। মেয়ে কিছু বোঝার আগেই ডাক্তার বাবু সরিয়ে নিয়ে গেলেন। 

পরদিন সকাল হতেই পিউ মাকে দেখতে না পেয়ে জিগ্যেস করে- ডাক্তার বাবু আমার "মা " । তিনি বলেন, আছে তোমার "মা" ওই যে দেখো দূর আকাশে। পিউ মাকে বলে ওঠে- তুমি মিথ্যে বলে গেলে, অনেকটাই বদলে গেছ "মা"।
(এক ক্যান্সার রোগীর ডায়েরি থেকে)
আর্কাইভ